স্টাফ রিপোর্টার : ভোটের আগেই লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের গুলির হিসাব দিতে ব্যার্থ হয়েছেন সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও একসময়ের অস্ত্রধারী দুর্ধর্ষ বিএনপি ক্যাডার রেজাউল করিম।
তিনি এবারও নওয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আ.লীগের প্রার্থী সাহেব আলীর সাথে প্রতিদ্বন্দীতা করছেন। কিন্তু ভোটের আগেই চেয়ারম্যান প্রার্থী রেজাউল করিমের আগ্নেয়াস্ত্রের গুলির হিসাবে গরমিল হওয়ার খবরটি সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়ায় এলাকায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে।
তার আগ্নেয়াস্ত্রের গুলির হিসাবে গরমিলের সত্যতা নিশ্চিত করে দেবহাটা থানার ওসি শেখ ওবায়দুল্লাহ ও পরিদর্শক (তদন্ত) ফরিদ আহমেদ বলেন, রেজাউল করিম তার লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য ৫০ রাউন্ড গুলি কিনেছিলেন। যারমধ্যে প্রায় ৪৫ রাউন্ড গুলি ইতোমধ্যেই খরচ হয়েছে বলে গুলির খোসা দেখিয়ে দাবী করছেন তিনি।
ওসি বলেন, আইনানুযায়ী কোন লাইসেন্সধারী ব্যাক্তি তার আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি খরচ করলে যতদ্রুত সম্ভব সুষ্পষ্ট কারন দেখিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরী করতে হয়। কিন্তু রেজাউল করিম তা করেননি। তিনি ৪৫ রাউন্ড গুলির খোসা একসাথে নিয়ে এসে ডায়েরী করতে চেয়েছিলেন।
যেহেতু তিনি কিভাবে বা কোন কারনে গুলি ছুড়েছেন তা খোসা দেখে বোঝার উপায় নেই বা সেটি বিশ্বাসযোগ্যও নয়, সেহেতু আমরা ডায়েরী নিইনি। রেজাউল করিমের গুলির হিসাব না মেলার বিষয়টি পুলিশ খতিয়ে দেখছে বলেও জানান ওসি।
এদিকে সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে আনারস প্রতিকের চেয়ারম্যান প্রার্থী রেজাউল করিমের সম্পর্কে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তার শাসনামলে নওয়াপাড়া ইউনিয়নে সংঘটিত বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডসহ নানা লোমহর্ষক ঘটনার তথ্য। রাস্ট্রীয় ক্ষমতায় তখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য শরীকদলের সমন্বয়ে গঠিত জোট সরকার।
২০০৩ সাল থেকে একাধারে ২০১১ সাল পর্যন্ত নওয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন সেসময়ের দুর্ধর্ষ অস্ত্রধারী বিএনপি ক্যাডার রেজাউল করিম।
তার শাষনামলের ওই ৮টি বছর ছিল নওয়াপাড়ার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন, বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারসহ সকল শ্রেনি পেশার মানুষেরা রেজাউল করিম ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর অবৈধ অস্ত্রের মুখে জিম্মি ছিল।
তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অবৈধ অস্ত্রের সন্ধানে তার বাড়িতে একাধিকবার অভিযান চালায় র্যাব ও সেনাবাহিনী। এতে র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে বেঁচে যান রেজাউল করিম।
আর সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতারসহ বেদম প্রহারের শিকার হয়েও পরবর্তীতে বর্তমানে কারাগারে থাকা বিএনপির এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিবের মধ্যস্থতায় ছাড়া পান তিনি।
চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনিসহ তার পরিবারের একাধিক অস্ত্রধারী ক্যাডার ও সন্ত্রাসীরা ওই ইউনিয়নের মানুষের ওপর চালিয়েছে অবর্ণনীয় অত্যাচার ও নির্যাতন। সেসময় শালিসের নামে ইউনিয়নের নীরিহ মানুষদের ইউনিয়ন পরিষদে দড়ি দিয়ে বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনও চালাতেন রেজাউল করিম।
শুধু তাই নয় সেসময়ে নওয়াপাড়া ইউনিয়নে একাধিক লোমহর্ষক ও নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটলেও, অদ্যবধি কোন হত্যাকান্ডেরই সুবিচার পাননি নিহতদের পরিবার।
প্রত্যেকটি হত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে তিনি, তার আত্মীয় স্বজন বা কাছের লোকজন জড়িত থাকায় নিহতদের পরিবারকে জিম্মি করে এসব হত্যাকান্ডের ঘটনা রেজাউল করিম নিজেই ধামাচাঁপা দিয়েছেন বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
নওয়াপাড়া ইউনিয়নের বেজোরআটির বাসিন্দারা জানান, বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এবং রেজাউল করিম নওয়াপাড়ার চেয়ারম্যান থাকাবস্তায় ২০০৪/০৫ সালে একটি প্রেমঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই গ্রামের দিনমজুর ওহাব আলীর ছেলে সাইদুলকে নৃশংসভাবে খুন করে দূর্বৃত্তরা।
এতে রেজাউল করিমের কাছের লোকজন জড়িত থাকায় হত্যাকান্ডটিকে আত্মহত্যা বলে বলে চালিয়ে দেন তিনি। একপর্যায়ে নিহতের পরিবারের আন্দোলনের মুখে হত্যার দুদিন পর পুলিশ দায়সারা একটি মামলা রেকর্ড করলে সাইদুলের লাশ দাফন করে তার পরিবার। কিন্তু অদ্যবধি ছেলেকে হত্যার বিচার পাননি নিহত সাইদুলের অসহায় বাবা মা।
সাংবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ২০০৯ সালে একটি মৎস্য ঘের নিয়ে ওই গ্রামের মৃত আনছার আলীর বড় ছেলে ফুটবলার অহিদকে রাতের আধারে ঘেরের বাসায় ঘুমন্ত অবস্থায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও কিরিস দিয়ে খুচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে দূর্বৃত্তরা।
এঘটনায় রেজাউল চেয়ারম্যানের চাচতো ভাই লিটন সরদার, সাজু সরদার এবাদুল মেম্বরসহ তাদের লোকজনের নামে মামলা করলেও রেজাউল বাহিনীর হুমকির মুখে শেষ পর্যন্ত হেরে যায় অহিদের পরিবার।
ওই ঘটনার বছর ঘুরতে না ঘুরতে একই মৎস্য ঘের নিয়ে পাশ্ববর্তী গাজীরহাটের রড সিমেন্ট ব্যবসায়ী রাজুর দশবছর বয়সী শিশুপুত্র ফয়সালকেও নৃশংসভাবে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর সখিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশে শিশুটির লাশ ফেলে রেখে যায় দূর্বৃত্তরা। সেই হত্যাকান্ডেরও কোন বিচার পাননি শিশু ফয়সালের বাবা-মা।
আটশতবিঘা এলাকার বাসিন্দারা জানান, আরেকটি মৎস্য ঘেরকে কেন্দ্র করে ২০০৬ সালের দিকে আটশতবিঘা গ্রামের সংখ্যালঘু মৃত গুরুপদ সিংয়ের ছেলে আনন্দ সিংকে নৃশংসভাবে হত্যার পর তার লাশ খালের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিল দূর্বৃত্তরা।
সেসময় রাস্ট্রীয় ক্ষমতায় বিএনপি এবং এলাকার চেয়ারম্যানও বিএনপির অস্ত্রধারী দুর্ধর্ষ ক্যাডার রেজাউল করিম থাকায় তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীর অস্ত্রের মুখে জিম্মি ছিলেন সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। ওই হত্যাকান্ডের পর রেজাউল বাহিনীর হুমকির মুখে মামলাও করতে পারেননি নিহত আনন্দ সিংয়ের পরিবার।
এমনকি বাধ্য হয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি করে আনন্দ সিংয়ের লাশটি সৎকার করে প্রান বাঁচান আনন্দ সিংয়ের বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যরা। এছাড়াও রেজাউল চেয়ারম্যানের শাসনামলে সেখানে সংঘটিত অন্যান্য হত্যাকান্ড বা এধরনের সহিংস কোন ঘটনারই বিচার পাননি ভুক্তভোগীরা।
২০১৩ সালে রেজাউল করিমের নেতৃত্বে নওয়াপাড়া ইউনিয়নের জামায়াত অধ্যুসিত গরানবাড়িয়া, বেজোরআটি, গাজীরহাট এলাকায় বেপরোয়া তান্ডব চালায় বিএনপি ও জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডাররা।
সেসময় রেজাউল করিমের ইশারায় গরানবাড়িয়াতে শ্রমিকলীগ নেতা আলমগীর হোসেনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও দুই চোখ উপড়ে হত্যা, দেবীশহরে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা শরৎ ঘোষ এবং জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের বর্তমান সভাপতি সুভাষ ঘোষের বাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবর রহমানের বাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ, হাদিপুরে আ.লীগ নেতা বিশ্বনাথ ঘোষের অফিস ভাংচুরসহ অসংখ্য সহিংস ঘটনা ঘটে।
এরকম অত্যাচারী, দুঃশাষক ও অস্ত্রধারী দুর্ধর্ষ বিএনপি ক্যাডার রেজাউল করিম ফের চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নওয়াপাড়াবাসী।
তাছাড়া নির্বাচন ঘিরেও রেজাউল বাহিনী এলাকাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারেন বলেও আশঙ্কা করছেন ভোটাররা। ফলে পুনরায় দুঃশাসন থেকে রেহাই পেতে ব্যালটের মাধ্যমে রেজাউলকে প্রত্যাখানের সিদ্ধান্তও নিচ্ছেন সেখানকার ভোটাররা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নিজেকে নির্দোষ দাবী করে রেজাউল করিম বলেন, আমার শাসনামলে এসব ঘটনা ঘটলেও এরসাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা ছিলনা।