আলতাফ হোসেন বাবু: “এপারের আযানের ধ্বনি ওপারে যায়, ওপারের শঙ্খ ধ্বনি আসে এপারে। এপারের পাখি যায় ওপারে, ওপারের পাখি আসে এপারে। সীমান্ত নদী ইছামতির এপারের মাছ যায় ওপারে, আবার ওপারের মাছ এপারে।
এভাবেই আবহমান কাল থেকে চলে আসছিল সম্প্রীতির সংস্কৃতি। প্রতি বছর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে সীমান্ত নদী ইছামতির বুকে ভাসতো দুই বাংলার মিলন মেলার তরী। ইছামতির তীরে আর সেই কোলাহল শোনা যায় না।
আগের মতো আর দুই বাংলার মানুষ এখন একসঙ্গে বিজয়ার উৎসবে মাততে পারেন না। তবে তাদের আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আজও। তাই এপার বাংলার বিসর্জনের দিনে ওপার বাংলার মানুষ ভিড় জমান ইছামতীর ওপারে।”
এভাবেই দুই বাংলার মানুষের সম্প্রীতির সেতুবন্ধনের ঐতিহ্য তুলে ধরে শিক্ষক ও সাংবাদিক এসএম শহীদুল ইসলাম বলেন, এপারে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা। ওপারে ভারতের উত্তর ২৪পরগনার হাসনাবাদ। মায়ের বিসর্জন লগ্নে কাছাকাছি দুই বাংলা। প্রতিমা নিরঞ্জন দেখতে ইছামতির পাড়ে ভিড় দুই বাংলার মানুষেরই। নৌকায় চড়ে বিসর্জন দেখতেন অনেকে। তবে এবার ওপার বাংলার মানুষের ইছামতিতে নামা নিষেধ ছিল। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় দুই বাংলার মানুষের আবেগ।
এ বিষয়ে ডা. সুব্রত ঘোষ বলেন, ভৌগলিক গণ্ডি দিয়ে কি রোখা যায় আবেগ। নদীর জল কাছে এনে দিয়েছে দুই বাংলাকে। ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে দুর্গাপূজার বিসর্জনের এই রেওয়াজ, তা কি এক নিয়মে বেঁধে রাখা যায়? বিসর্জনের লগ্নেই মিলেমিশে একাকার সীমান্ত পারের আবেগ। বিজিবি-বিএসএফের কড়া নজরদারি সত্ত্বেও বিসর্জনের জলতরঙ্গে একাকার দুই বাংলার মন। মনের মিলনে নজরদারি চালানোর সাধ্য কারই বা আছে!
তিনি আরও বলেন, ২০১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দিনটি ছিল দুই বাংলার মানুষের মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়ার দিন। এই বিশেষ দিনটিতে দুই বাংলার মানুষ একত্রিত হতে পারতেন। কিন্তু ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রচুর বাংলাদেশি নাগরিক এই সুযোগে ভারতে ঢুকে যায় বলে অভিযোগ ওঠে। তারপর থেকেই দুই বাংলার মানুষ এখন একসঙ্গে বিসর্জন পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় একসঙ্গে দুই বাংলার প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য আর দেখা যায় না।
এদিকে বিজয়া দশমীতে শ্যামনগরের দুর্গাবাটি খোলপেটুয়া নদীর পাড়ে নামে হাজারো মানুষের ঢল। ঢাক, কাঁশের বাদ্য-বাজনার মধ্য দিয়ে রাত্রি উজ্জ্বল করা আরতি ও পূজারি-ভক্তদের পূজা-অর্চনায় কেবলই দেবী দুর্গার বিদায়ের আয়োজন। রবিবার শুভ বিজয়া দশমীতে শ্যামনগর বুড়িগোয়ালিনী দুর্গাবাটি খোলপেটুয়া নদীর বুকে শতশত ট্রলার ভাসতে দেখা যায়। গত পাঁচদিন পূজা উদযাপন শেষে সব পূজামণ্ডপেই নামে বিষাদের ছায়া।
গত কয়েক বছর সাতক্ষীরার দেবহাটায় ইছামতি নদীতে ভাসতো দুই বাংলার মিলনমেলার তরী। কিন্তু ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে আর সেই তরী ভাসে না। নিজ নিজ দেশের সীমান্ত রেখায় সবাই প্রতিমা বিসর্জন দেয়। দুই বাংলার মানুষের একই নদীর মোহনায় দেখা হয় কিন্তু কথা হয় না। তবে দুই দেশের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকায় শ্যামনগর উপজেলার দুর্গাবাটি খোলপেটুয়া নদীর বুকে ভাসানো হয় আনন্দ তরী। পাড়ে জমা হয় হাজার হাজার মানুষ। প্রতিমা বিসর্জনে মেতে ওঠেন সবাই।