করোনা ভাইরাসের বহুল প্রতিক্ষিত টিকা বিশ্বের ৫৪তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়া শুরু হয়। করোনা ভাইরাসের
গতি-প্রকৃতি, চিকিৎসার ওষুধ ও টিকা, পার্শ্ব বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া, ইত্যাদি নিয়ে মানুষের মনে নানা কৌতূহল ও সন্দেহের উদ্রেক শুরু হয়েছিলো; যা খুবই স্বাভাবিক।
কারণ এই ভাইরাসটি পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত আসা অণুজীবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছোঁয়াচে এবং এর কোন চিকিৎসা পদ্ধতিও জানা ছিল না। করোনার প্রভাব ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করায় মানুষ টিকার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। মহামারী থেকে নিজেকে রক্ষা করতে টিকার বিকল্প নেই।
ভারতের পাশাপাশি ইতোমধ্যে চীন ও আমেরিকা থেকে টীকা এসেছে, যা সারা দেশে প্রয়োগও
চলছে। কিন্তু মানুষের ব্যপক আগ্রহের কারণে টিকার জন্য নিবন্ধন করেও টীকা গ্রহনে বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে।
২০২০ সালের ২৫ মার্চ দেশ লকডাউনের পর থেকে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ছিলো। দেশে করোনার অল্প বিস্তারের সময় এলাকা ভিত্তিক লকডাউন, স্প্রে ছিটানো, হাট-বাজারে শারিরীক দুরত্ব স্থাপন, কাঁচা বাজার খোলা মাঠে নেয়াসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো।
কিন্তু যখন করোনার বেশি বিস্তার তখন এই উদ্যোগগুলো নেয়া হয়নি। মূলত মানুষের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক দূর হয়েছে করোনা নিয়ে। মুখে সচেতন থাকলেও কার্যক্ষেত্রে কতজন স্বাস্থ্যবিধি মানছেন?
দেশে করোনায় মৃত্যুর মিছিল বাড়লেও প্রয়োজনের তাগিদে মানুষের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক নেই, নেই প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা। সরকার মৃত্যু ও সংক্রামণ ঠেকাতে লকডাউনের পাশাপাশি টিকা দানের বিশাল এক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে। অন্যদিকে, করোনার টিকা বিতর্কিত করতে মাঠে নেমেও ব্যার্থ হয়েছে কুচক্রী মহল।
সত্যকে দীর্ঘদিন চাপা দিয়ে রাখা যায় না। প্রতিদিন যেভাবে বিশ্বে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে, তাতে তো বিজ্ঞানীরা সব ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। মানুষকে বাঁচাতে হলে রোগীকে চিকিৎসা দিতে হবে, প্রতিরোধের জন্য টিকা বের করতে হবে, প্রতিরোধের জন্য আবশ্যকীয় স্বাস্থ্য বিধিগুলো মানতে হবে।
এতদিন টিকা ছিল না, টিকা পেয়েছি, যা কাজে লাগাতে হবে। ভারত থেকে আসা টিকাকে ঘিরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানা ধরনের সংশয়ের সৃষ্টি করা হয়েছিল। এমন দাবিও জানানো হয়েছিল, সংশয় দূর করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর উচিত প্রথম টিকা নেয়া।
নিন্দুকের ভয়ে আমরা আর্তের পাশে দাঁড়াতে গিয়েও উপেক্ষা করে চলে যায়; মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে ব্যর্থ হই। কারণ, লোকে কী মনে করবে, কী ভাববে এ কথা ভেবে আমরা শঙ্কিত হয়ে পড়ি অথচ অপরের মঙ্গলের জন্য কাজ করার ইচ্ছা প্রত্যেক মানুষের মনেই থাকে এবং তার ফলে মহৎ কাজে ইচ্ছুক মানুষের মনে বোদ্ধাদের মতো অসংখ্য শুভবুদ্ধির উদয় হয়।
মানুষের সমালোচনার ভয়ে আমরা ভীত ও লজ্জিত থাকি বলেই কোন কাজ করতে পারি না। টিকার ক্ষেত্রে এসব থেকে বেরিয়ে এসেছে মানুষ।
করোনা মহামারির মধ্যেও সাতক্ষীরায় এ ভাইরাস প্রতিরোধক টিকা নিয়ে শুরু হয়েছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। প্রতিদিন টিকা নিতে এসে ফিরে যাচ্ছেন শত মানুষ।
নিবন্ধন করেও দিনের পর দিন টিকা নিতে না পেরে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন তারা। জেলায় নিবন্ধন করে এসএমএস পেয়েও টিকা নিতে পারেনি প্রায় ৫ হাজার মানুষ। এ ছাড়া প্রথম ডোজ সম্পন্ন করে দ্বিতীয় ডোজের টিকা পাননি অন্তত ৩০ হাজার মানুষ।
আবার টিকা নিতে সকাল ৭টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে মানুষকে। এমন সংবাদ স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। গত ০৮ জুলাই সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে টিকা নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করে এখনও এসএমএস না আসায় টিকা নিতে পারেনি অনেকেই।
অথচ একই সময়ে নিবন্ধন করে পার্শবর্তী যশোর জেলার মনিরামপুর থেকে টিকা নিয়েছেন একাধিক ব্যক্তি। ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়, টিকা প্রাপ্তি সহজ হলো কি?
করোনা মহামারী থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো টিকাদান কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা। সরকার এ বিষয়ে শুরুতে হোঁচট খেলেও বর্তমানে টিকার ঘাটতি নেই। ২২ জুলাই পর্যন্ত দেশে প্রথম ডেজ টিকা নিয়েছেন ৭১.৮৯ লক্ষ মানুষ।
আর গত ২৪ ঘন্টায় নিয়েছেন ১.৮০ লক্ষ মানুষ। দ্বিতীয় ডেজ নিয়েছেন ৪৩.০১ লক্ষ মানুষ আর গত ২৪ ঘন্টায় নিয়েছেন ৭৩৩ জন। পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে মানুষ টীকা গ্রহণে পূর্বের থেকে সচেতন হয়েছেন।
সরকার টিকা গ্রহণের বয়স ৪০ থেকে ৩৫ বছর সর্বশেষ ৩০ বছরে নামিয়ে এনেছে। জেলা হাসপাতালে প্রতিদিন ১৫০ জনের টিকা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিনই তার চেয়ে বেশি মানুষ নিবন্ধন করছেন।
আবার বয়স ৩০ হওয়ায় নিবন্ধন বাড়বে আরো বেশি। ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষ নিবন্ধন করেও দিনের পরে দিন টিকা নিতে পারছেন না। সরকার টিকাদানে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করলেও স্থানীয় ব্যবস্থাপনা কি যথেস্ট?
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। হাসপাতালের সীমাবদ্ধতা দূর টিকা দানের বুথ সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে নার্সিং ইনস্টিটিউটের অভিজ্ঞ শিক্ষানবিশদের কাজে লাগাতে হবে।
টিকা দানের সময় বাড়াতে হবে।
মহামারী থেকে মানুষকে বাঁচাতে টিকা আরো সহজলভ্য করতে হবে। গ্রামের অল্প শিক্ষিত-অশিক্ষত মানুষকে অবশ্যই টিকার আওতায় আনতে হবে। এ জন্য রেজিস্ট্রেশনের পাশাপাশি বিনারেজিস্ট্রেশনে টিকা দান করতে হবে।
কারণ গ্রামের অনেক মানুষ রেজিস্ট্রেশন ঝামেলা মনে করছে। স্মার্ট ফোন ও প্রযুক্তি না থাকায় রেজিস্ট্রেশন করতে পারছে না। আবার অনেকে এসএমএস বোঝে না, কোম্পানীর অফারের এসএমএস এর ভিড়ে টিকার এসএমসে হারিয়ে যায়।
এজন্য ইউনিয়ন ভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিকে যেহেতু বিভিন্ন টিকা দেয়া হয় তাই করোনা
টিকাও সঠিকভাবে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানে বিনা রেজিস্ট্রেশনে শুধুমাত্র জাতীয় পরিচয়পত্র দেখেই টিকা দিতে হবে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি টিকা দানের স্থান ও সময় মসজিদের মাইকে প্রচার করলে অল্প সময়ে বেশি মানুষ আসবে। ফলে জেলা ও উপজেলা সদরে চাপ কমবে এবং গ্রামের সহজ সরল মানুষ আগ্রহী হবে। তবেই টিকাদান কর্মসূচী শতভাগ সফল হবে। করোনা মুক্তির সূর্য বাংলাদেশে আসবেই।
…………………………………………………………………..
লেখক: নাজমুল হক, প্রাক্তন খুলনা বিভাগীয় সিনিয়র রোভার মেট প্রতিনিধি,
উত্তর কাটিয়া, সাতক্ষীরা ০১৭৭২-৮৭৬৭৪৪