স্টাফ রিপোর্টার : বিস্তৃর্ণ রেকর্ডিয় জমির তিন শতাধিক মালিককে হটিয়ে জবরদখলকৃত ভূমিদস্যুদের বহুল আলোচিত জনপদ ও অন্তত হাফ ডজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনীর অভয়ারণ্য খলিশাখালী বর্তমানে বিপুল পরিমান অবৈধ অর্থ এবং সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বাহিনী গুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
গেল বছরের ১০ সেপ্টেম্বর ভোররাতে স্থানীয় ইছাদ আলীর ছেলে ভূমিদস্যু বাহিনী প্রধান আনারুলের নেতৃত্বে মুহুর্মুহু বোমা ও গুলিবর্ষন করে আতঙ্ক সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া মৌজার ৩০টি খন্ডে বিভক্ত খলিশাখালী নামক ব্যাক্তি মালিকানাধীন ওই ৪৩৯.২০ একর (১৩২০ বিঘা) সম্পত্তির মৎস্য ঘের জোরপূর্বক দখল করে নেয় কয়েকশ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা।
জবরদখল পরবর্তী বিস্তৃর্ণ ওইসব মৎস্যঘের থেকে তাৎক্ষনিক কোটি টাকার বাগদা চিংড়ীসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও ঘেরের বাসায় থাকা আসবাবপত্র, গবাদিপশু লুট করে নেয় জবর দখলকারীরা।
তাছাড়া বিগত পাঁচমাসে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে জবরদখলকৃত ১৩২০ বিঘা জমিতে কথিত ভূমিহীন পূণর্বাসনের নামে শতশত ভূমিদস্যুদের কাছে জমি বেচাকেনা ও হাতবদল করে আরও অন্তত দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সেখানকার মুল নেতৃত্বে থাকা ভূমিদস্যু বাহিনী প্রধান আনারুল।
একের পর এক সেখানে গড়ে তোলে কমপক্ষে হাফ ডজন ভূমিদস্যু ও অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনীর অভয়ারণ্য। আর এসব সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং পুলিশ-প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের ম্যানেজ করতে আনারুল বাহিনীর কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তাদের মদদদাতা কিছু জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা ও জেলা-উপজেলার ভুইফোঁড় কিছু মিডিয়ার কয়েকজন কথিত সাংবাদিক।
বহাল তবিয়তে খলিশাখালীর জবরদখলীয় বিস্তৃর্ণ সম্পত্তি, বিপুল পরিমান অবৈধ অর্থ ও গোটা জনপদের নিয়ন্ত্রন আঁকড়ে রাখতে আনারুল তার এসব অপকর্মে সঙ্গী করে নেয় খলিশাখালীর শাহজাহান গাজীর ছেলে রবিউলকে। নিজে সভাপতি ও রবিউলকে সম্পাদক করে খলিশাখালীতে গড়ে তোলে কথিত ভূমিহীন কমিটি।
নামে ভূমিহীন কমিটি হলেও, রবিউলকে কাঠের পুতুল বানিয়ে কথিত এ কমিটির মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার পরিবারকে রাতারাতি সদস্য বানিয়ে রেকর্ডিয় মালিকদের কাছ থেকে জবরদখলকৃত খলিশাখালীর জমি বিঘাপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রত্যেক সদস্যের কাছে বিক্রি শুরু করে ভূমিদস্যু আনারুল।
পাশাপাশি দখলদারিত্ব বজায় রাখতে প্রত্যেক পরিবারের কাছ থেকে কয়েক দফায় প্রায় ১০ হাজার টাকা হারে চাঁদাও নেয় সে। সবমিলিয়ে জবরদখলকৃত শতশত বিঘা মৎস্য ঘের থেকে লুন্ঠিত মাছসহ অন্যান্য সম্পদ ও জমি বিক্রিসহ বহাল তবিয়তে চাঁদাবাজি করে খলিশাখালী থেকে এপর্যন্ত প্রায় তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ভূমিদস্যু বাহিনী প্রধান আনারুল।
বিপুল পরিমান এ অবৈধ অর্থ এবং জমির ভাগবাটোয়ারা ও হিসাব চাওয়াকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি ভূমিদস্যু আনারুল গ্রুপের সাথে রবিউল ও তার লোকজনের গোলযোগ বেঁধেছে। মঙ্গলবার (৮মার্চ) খলিশাখালীতে এনিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে আনারুল ও রবিউল গ্রুপের লোকজন।
সেসময় প্রায় ঘন্টাব্যাপী দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষণের ঘটনাও ঘটে। এতে রবিউল গ্রুপের অন্তত পাঁচজন গুরুতর আহত হন। এরপর থেকে ভূমিদস্যু অধ্যুসিত ওই জনপদের নেতৃত্ব থেকে লোকজনসহ অনেকটাই সরে গেছেন রবিউল। ফলে খলিশাখালীর তিন কোটি টাকা, ১৩২০ বিঘা জমিসহ গোটা রাজত্ব এখন ভূমিদস্যু আনারুল ও তার অনুসারী বাহিনী গুলোর দখলে।
ভূমিদস্যু আনারুল ও তার নিয়ন্ত্রিত বাহিনীগুলোর অবৈধ অস্ত্রের কাছে জিম্মি খলিশাখালীর ভুক্তভোগীরা জানায়, জবরদখল পরবর্তী খলিশাখালী থেকে মাছ, জমি ও অন্যান্য সম্পদ বেঁচাকেনা এবং আইনী জটিলতা ও প্রশাসন সামলানোর নামে সেখানে বসবাসরতদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে এপর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ভূমিদস্যু আনারুল।
সেখানকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন এবং যাবতীয় অর্থ আনারুলের পকেটে। তাছাড়া খলিশাখালীর জমি দেয়ার নাম করে প্রায় দেড় হাজার পরিবারের কাছ থেকে দফায় দফায় অর্থ হাতিয়ে নিলেও এখনও কমপক্ষে দুই শত পরিবারকে জমি দেয়নি আনারুল বাহিনী। এসব ভুক্তভোগীরা জমির ভাগবাটোয়ারা এবং তিন কোটি টাকার হিসাব চাইতে গেলেই তাদের বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যার হুমকি দিচ্ছে আনারুল।
বিপুল পরিমান এসব অবৈধ অর্থ আনারুল তার শ্যালক জামালসহ কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লুকিয়ে রেখেছে এবং মাছের আড়ৎ ও কয়েকটি ব্যবসাও খুলে বসেছে বলে জানিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আনারুলের কয়েকজন অনুসারী।
ভুক্তভোগীরা আরোও বলেন, সম্প্রতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে খলিশাখালীতে উচ্ছেদাভিযান পরিচালনার ঘোষনা দেয়ার পর আনারুল সেখানে অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিষ্ফোরক এবং ইয়াবা’র পাহাড় গড়ে তোলার পাশাপাশি সন্ত্রাসী বাহিনী ও অপরাধীদের আস্তানা গড়ে তুলেছে।
সাতক্ষীরার অন্যতম কুখ্যাত আকরাম ডাকাতের নেতৃত্বাধীন আকরাম বাহিনী, স্থানীয় এক মেম্বরের নেতৃত্বাধীন অস্ত্রধারী আরেকটি বাহিনী, গফুর মাস্তানের নেতৃত্বাধীন বাহিনী, মুর্শিদ ও শাহিনুরের যৌথ নেতৃত্বাধীন বাহিনী এবং অহিদুল ও মনি’র বাহিনীসহ কয়েকটি ভাড়াটে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী খলিশাখালীতে অবস্থান করছে।
বহু মামলার আসামী সিদ্দিক গাজী, আকরাম ঢালী, গফুর মাস্তানসহ জেলার অসংখ্য দাগী অপরাধীর বর্তমান অভয়ারণ্য খলিশাখালী। ভূমিদস্যু আনারুলসহ তার অনুসারী এসব বাহিনীর কাছে পর্যাপ্ত সংখ্যক দেশি-বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র, হাতবোমা ও বিষ্ফোরকসহ বোমা তৈরীর সরঞ্জাম থাকায় তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে গোটা খলিশাখালী জনপদ। সম্প্রতি উচ্ছেদাভিযান ঠেকাতে উচ্চ আদালত থেকে একটি স্থগিতাদেশ নিয়ে ফের এসব সন্ত্রাসী ও ভূমিদস্যুরা খলিশাখালী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এদিকে খলিশাখালীর জবরদখলকৃত ৪৩৯.২০ একর জমি পুনরূদ্ধারসহ রেকর্ডীয় মালিকদের অনুকূলে ফিরিয়ে দিতে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত তিন শতাধিক জমির মালিক।