ডেস্ক রিপোর্ট : দক্ষিণ সুদানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়নেও সফলভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ইতোমধ্যে ৪০০ কিলোমিটার রাস্তার কাজ সমাপ্ত হয়েছে। আরো ২৬০ কিলোমিটার রাস্তা বর্ষার আগেই শেষ করার বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে।
দক্ষিণ সুদানে বৈরী আবহাওয়ার পাশাপাশি পোকা-মাকড়, সাপ ও মশার উত্পাতও রয়েছে। শান্তিরক্ষী বাহিনীর তিন শতাধিক সদস্য ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত। তারপরও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশটির উন্নয়নে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মানবতার সেবায় নজির স্থাপন করেছেন।
দেশটির রাজধানী জুবা ব্যতীত সমগ্র দেশের রাস্তা কাঁচা। এই রাস্তাগুলো পাকা ও মেরামতের কাজ ধাপে ধাপে করে যাচ্ছেন শান্তিক্ষীরা। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় কাদা হয়ে যায়। আর সেই কাদায় আটকে যায় যানবাহন। তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা হেলিকপ্টর দিয়ে সেই যানবাহন নিয়ে আসেন। দক্ষিণ সুদান সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ সবাই এক বাক্যে বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে তারা যে সেবা পাচ্ছেন তা তাদের ধারণার বাইরে। একদিকে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন, অন্যদিকে অবকাঠামো উন্নয়ন ও মানবতার সেবা দিয়ে যাচ্ছেন অত্যন্ত আন্তরিকভাবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
বাংলাদেশ নাম শুনলেই দক্ষিণ সুদানবাসীর মুখ থেকে ‘গুড’ শব্দটি উচ্চারিত হয়। দক্ষিণ সুদানের আবহাওয়ায় মাত্র দুটি ঋতু। একটি শুকনো মৌসুম এবং অন্যটি বর্ষাকাল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বর্ষা মৌসুম বেড়ে ৭ মাস হয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা ইঞ্জিনিয়ারদের বাইরে নিয়ে যায় কাজ করার জন্য। অর্থাৎ বছরে পাঁচ মাস অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলে। দক্ষিণ সুদানে প্রায় এক দশক ধরে চলছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কার্যক্রম।
দেশটিতে বিশ্বের ৫২টি দেশের প্রায় ১৪ হাজার শান্তিরক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত ফোর্স কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল মাঈন উল্লাহ চৌধুরী। তিনি ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার হিসেবে নিয়োজিত। অতিসম্প্রতি তিনি ভারপ্রাপ্ত ফোর্স কমান্ডারের দায়িত্ব পেয়েছেন।
অন্যদিকে দক্ষিণ সুদানের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রাজধানী জুবার সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এফ এম আতিকুর রহমান। তারা বলেন, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা এখানে কঠোর পরিশ্রম ও পূর্ণ পেশাদারিত্বের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করছেন।
মেজর জেনারেল মাঈন উল্লাহ চৌধুরী বলেন, একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমি গর্বিত যে এই অন্তর্বর্তীকালে নতুন ফোর্স কমান্ডার না আসা পর্যন্ত আমাকে অ্যাকটিং ফোর্স কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি এজন্য জাতিসংঘ, বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধানকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, গুরুত্বপূর্ণ এই মিশনে পাঠানোর জন্য।
তিনি বলেন, দক্ষিণ সুদানের এই মিশনটি খুব সহজ নয়। এখানে অনেক জটিলতা আছে। ভূরাজনৈতিক বিষয় জড়িত রয়েছে। যার ফলে এখানে ফোর্স কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অনেক চ্যালেঞ্জের। এখানে আমাদের দুই ধরনের সামরিক সদস্যরা কাজ করছেন। তাদের একাংশকে আমরা বলি টিসিসি বা ট্রুপস কন্ডিবিউটিং কান্ট্রি থেকে যারা আসেন। আর কিছু সদস্য আসেন এমএলও বা মিলিটারি লিয়াজোঁ অফিসার বা মিলিটারি অবজারভার হিসেবে।
তাদের কাছে কোনো অস্ত্র থাকে না। তারা শুধু সাদা পতাকা ও ইউএন পাতাকা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারেন। এই অস্ত্রসহ এবং অস্ত্র ছাড়া দুই অংশ মিলিয়ে বিশ্বের ৫২টি দেশের সদস্য এখানে রয়েছেন। তাদের পুরো কাজটি সমন্বয় করতে হয় ফোর্স হেড কোয়ার্টার থেকে। এখানে অনেক উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। মিশন হেড কোয়ার্টার থেকে। আমরা এটি সমন্বয় করি।
মেজর জেনারেল মাঈন উল্লাহ চৌধুরী আরো বলেন, বাংলাদেশের শান্তিরকক্ষীরা এখানে ইনসেপারেবল ফোর্স হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা যেখানে যাচ্ছে সেখানেই প্রশংসিত হচ্ছেন। তারা সিভিল মিলিটারি কো-অপারেশনের (সিমিক) মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে সহায়তা দিচ্ছে। এতে শুধু বাংলাদেশের সুনামই প্রস্ফুটিত হচ্ছে না, জাতিসংঘের ম্যান্ডেটটাকে সামনে নিয়ে যাওয়ার কাজটিও তারা করছে।
এটি জাতিসংঘ অত্যন্ত ভালোভাবে উপলব্ধি করছে এবং নানা কাজের মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশকে অনুকরণীয় বলে মনে করছে। বাংলাদেশি সৈন্যদের যে কোনো জায়গায় পাঠাতে তারা আগ্রহী। দক্ষিণ সুদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রাজধানীর জুবা মাল্টি সেক্টরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এফ এম আতিকুর রহমান বলেন, চায়না, রুয়ান্ডা, ইথিওপিয়া, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের কন্টিনজেন্ট রয়েছে এই সেক্টরে। আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য অত্যন্ত গর্ববোধ করছি।
এখানে নিয়োজিত বাংলাদেশের চারটি কন্টিনজেন্ট আনমিসের ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা দক্ষিণ সুদানের বেসামরিক জনগণের জান ও মালে নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করছে। বিভিন্ন দেশ গঠনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশটির উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রতি এ দেশের জনগণের গভীর আস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের কাজের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ সুদানে একটি বিশেষ অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ সুদানে বাংলাদেশের সামরিক পর্যবেক্ষক, স্টাফ অফিসার এবং বিভিন্ন কন্টিনজেন্টের ফিমেল এনগেজমেন্ট টিমগুলো অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে।