মাহমুদুল হাসান শাওন, দেবহাটা : চলতি অর্থবছরে বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের অন্যতম রোল মডেল। দেশজুড়ে অবকাঠামোগত এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছে বর্তমান সরকার।
দেশের সবচেয়ে সুবিধা বঞ্চিত, অসহায় ও দারিদ্র শ্রেনীর মানুষ হিসেবে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৪৯ লক্ষ মানুষকে মাসিক ভাতা সুবিধার আওতাভুক্ত করে দেশে শতভাগ ভাতা সুবিধা নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুধু শতভাগ ভাতা সুবিধা চালু নয়, ১৯৯৭-৯৮ সালে জনপ্রতি মাসিক একশ টাকা, ২০০৯-১০ সালে আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা থাকালেও, ২০২০-২১ অর্থ বছরে মাথাপিছু সে টাকার পরিমান বৃদ্ধি করে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা পাঁচশ টাকা এবং প্রতিবন্ধী ভাতা মাথাপিছু সাড়ে সাতশ টাকায় উন্নীত করেছে সরকার।
একইসাথে বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকে লাইনে দাঁড়িয়ে ভাতার টাকা নেয়ার পরিবর্তে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঘরে ঘরে ভাতা পেঁৈছ দেয়ার ব্যবস্থাও করেছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সরকারের এতো ডিজিটালাইজেশন স্বত্ত্বেও শকুনের নজর পড়েছে অবহেলিত বয়োজ্যেষ্ঠ বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের মাসিক ভাতার টাকায়।
চলতি বছর শতভাগ ভাতা সুবিধা চালু হওয়ার পর কেবলমাত্র সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে ৬৭২২ জন বয়স্ক, ৩২৮৭ জন বিধবা ও ২৫১৮ জন প্রতিবন্ধী মিলিয়ে মোট ভাতাভোগীর সংখ্যা দাড়িয়েছে ১২,৫২৭ জনে।
যাদের মধ্যে বয়স্ক ও বিধবারা প্রতিমাসে মাথাপিছু ৫শ টাকা এবং প্রতিবন্ধীরা ৭৫০ টাকা করে ভাতা পান বলে উল্লেখ আছে সমাজসেবা অফিসের খাতাকলমে। অথচ ভাতার টাকা প্রাপ্তির ভোগান্তি কমাতে সরকার গৃহীত আধুনিক মোবাইল ব্যাংকিং সেবার আড়ালে সমাজসেবা অফিসারের দায়িত্বহীনতার কারনে দেবহাটার কমপক্ষে দেড় হাজার অসহায় ভাতাভোগীর ৮/১০ লাখ টাকা উধাও হওয়ার তথ্য বেরিয়ে এসেছে অনুসন্ধানে।
উপজেলা সমাজসেবা অফিসার অধীর কুমার গাইনের দায়িত্ব হীনতার কারনেই নাকি এসব টাকা খোয়া গেছে বলে অভিযোগ অসহায় ভাতাভোগীদের। আর খোয়া যাওয়া টাকার বিষয়ে একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা সমাজসেবা অফিসার অধীর কুমার গাইন ও মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’।
উপজেলার কুলিয়া, পারুলিয়া, সখিপুর, নওয়াপাড়া ও দেবহাটা সদর ইউনিয়নে সবমিলিয়ে অন্তত দেড় হাজার অসহায় ভাতাভোগী এবছরের তৃতীয় কিস্তিতে তাদের ভাতার টাকা পাননি বলে নিশ্চিত করেছেন এসব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বররা।
পারুলিয়া ইউনিয়নের জোয়ার গুচ্ছগ্রামের ভাতাভোগী আব্দুস সামাদ মোল্যা (৮০), তার স্ত্রী জোহরা খাতুন (৭০), তাছলিমা (৪৫), সবুজান বেগম (৬৫), নুরজাহান বিবি (৭০), প্রতিবন্ধী মেয়ে সালমা (২২), জবেদা বেগম (৯০), ফতেমা বেগম (৭৫), চালতেতলা গ্রামের সবিরন (৫৫) এবং একই গ্রামের সবজান বিবি (৮৫) সহ অন্যান্যরা আকুতি করে বলেন, ‘আমাদের ভাতা সুবিধা তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করায় আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ।
সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত হওয়ায় এই ভাতার টাকাতেই আমাদের খরচ জুটতো। কিন্তু গেল কয়েক মাসের ভাতার টাকা আমাদের মোবাইলে আসেনি। আমরা বর্তমানে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছি।
বারবার সমাজসেবা অফিসারের অফিসে গিয়ে ধরনা দিয়ে এবং আমাদের নামের তালিকায় মোবাইল নাম্বার যুক্ত করেও আমরা টাকা পাইনি। আমাদের ভাতার টাকা ভুল করে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে গিয়েছে বলে সমাজসেবা অফিসার আমাদেরকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।’
টাকা না পাওয়া ভাতাভোগীদের মধ্যে সামাদ মোল্যা ও তার স্ত্রী জোহরা খাতুন বলেন, এলাকায় জনপ্রতিনিধি থাকা স্বত্ত্বেও ফারহানা পারভীন নামে এক নারীকে দিয়ে সমাজসেবা অফিসার অধীর কুমার গাইন আমাদের নাম ও মোবাইল নম্বর সুবিধা ভোগীর তালিকাভুক্ত করান।
পরবর্তীতে মোবাইলে ভাতার টাকা না এলে ফারহানা আমাদের বলে ‘তোমাদের টাকা অন্য জেলার মানুষের মোবাইলে ভুল বশত চলে গেছে’। একপর্যায়ে চাপপ্রয়োগ করলে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ভাতা বাবদ ৬ হাজার টাকা থেকে মাত্র দেড় হাজার টাকা ফেরত দেন।
পারুলিয়ার ইউপি সদস্য মকরম শেখ বলেন, অসহায় বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সমাজসেবা অফিসার অধীর কুমার গাইন ও মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান নগদ এর কারসাজিতে এসব অসহায় মানুষের লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। বারবার অফিসে ডেকে মোবাইল নম্বর ঠিক করে নেয়া স্বত্ত্বেও উপজেলার এতোগুলো সুবিধাভোগীর মোবাইল নাম্বার ভুল হওয়া কাকতালীয় বিষয় হতে পারেনা।
সুবিধা ভোগীরা সঠিক নাম্বার দিলেও, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ও সমাজসেবা অফিসের লোকজন যোগসাজোসে তালিকায় ইচ্ছেমতো নাম্বার বসিয়ে দিয়ে অর্থ লোপাট করেছে। কোনভাবেই সমাজসেবা অফিসার এ দায় এড়াতে পারেননা। কেননা মোবাইল নাম্বারসহ তালিকা প্রস্তুত করে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান নগদ-কে সরবরাহ করার দায়িত্ব সমাজসেবা অফিসের, সুবিধা ভোগীর নয়।
তিনি আরোও বলেন, এলাকায় আমরা জনপ্রতিনিধি থাকা স্বত্ত্বেও দক্ষিন পারুলিয়া মাতৃকেন্দ্রের সম্পাদিকা ফারহানা পারভীনকে দিয়ে সমাজসেবা অফিসার অধীর কুমার গাইন ইচ্ছেমতো ভাতা ভোগীদের তালিকা প্রণয়ন এবং সুবিধা ভোগীর মোবাইল নম্বরও সংগ্রহ করান।
সমাজসেবা অফিসে ফারহানা পারভীনের কোন দায়িত্ব না থাকা স্বত্ত্বেও কেবলমাত্র ব্যাক্তিগত সখ্যতার কারনে সমাজসেবা অফিসার অবৈধভাবে এসব কর্মকান্ড করেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
এব্যাপারে অভিযুক্ত সমাজসেবা অফিসার অধীর কুমার গাইন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান নগদ’র ওপর সব দায় চাপিয়ে বলেন, মোবাইল নম্বর ভুল হওয়ার কারনে এসব ভাতাভোগীর টাকা বিভিন্ন জেলার মানুষের মোবাইল অ্যাকাউন্টে চলে গেছে।
তবে এঘটনায় তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাছলিমা আক্তার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *