সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা একটি ঐতিহ্যবাহী উপজেলা। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের আন্তর্জাাতিক সীমানা নির্ধারনকারী নদী ইছামতি নদীর ধার ঘেষে দেবহাটা উপজেলার অবস্থান। এই ইছামতি নদীতে শারদীয় দুর্গাপূজার বিজয়ার দিন দুই বাংলার প্রতিমা বিসর্জন হয়। মিলেমিশে এক-একাকার হয়ে যায় দুই টুকরো বাংলা কিছু সময়ের জন্য, যে সোনার বাংলাকে রাজনৈতিক কুটচালে দু’টুকরো করেছিল ব্রিটিশরা।

ইছামতির ওপারে রয়েছে ভারতের হাসনাবাদ রেলষ্টেশন। যার কারনে সেসময়ে এ অঞ্চলের মানুষের দ্বিতীয় ঠিকানা ছিল কোলকাতা শহর। তারা অনায়াসেই রেলে করে কোলকাতা যেতে পারতেন। তখন ছিল না ভিসা-পাসপোর্ট আর কাটা তারের বেড়া- ছিল অবাধ বিচরণ, এপার বাংলা-ওপার বাংলা।

এই দেবহাটার সুশীলগাতী গ্রামে রয়েছে উপমহাদেশের প্রখ্যাত মানবিক চিকিৎসক ও বিশ্ব বরেন্য রাজনৈতিক ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের পৈত্রিক বাড়ি যা বিলীন হয়ে যাবার অপেক্ষায়। ভিটেমাটি দখল হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিছু মানুষ উদ্যোগ নিয়ে একটি নাম ফলক না লাগালে হয়তবা বোঝাই যেত না সেখানেই ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের পৈত্রিক ভিটা ছিল। এভাবেই কালের গর্ভে হয়তবা একদিন বিলীন হয়ে যাবে এই মনিষীর শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও- যা হচ্ছে অহরহ সব জায়গাতে।

টাউন শ্রীপুরে রয়েছে ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শংকর রায় চৌধুরীর পৈত্রিক নিবাস। তিনি সেনা প্রধান থাকাকালে ১৯৯৭ সালে একবার ছুঁয়ে গিয়েছিলেন তার হারানো শৈশবের স্মৃতি আর সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন এই জন্মভূমির পবিত্র মাটি। অবসরকালীন জীবনে তিনিও তাঁর শৈশবের স্মৃতিটুক খুঁজে ফেরেন বলে শোনা যায় যারা তাঁর সান্নিধ্যে যান তাদের মুখে।

এই দেবহাটার নামকরন নিয়ে কেউ বলেন, প্রাচীনকালে এখানে দেব-দেবীর হাট বসত, সেজন্য নাম হয়েছে দেবহাটা। আবার কেউ বলেন, প্রাচীনকালে এখানে ঘন জঙ্গল ছিল। সেই জঙ্গলে বিভিন্ন বনদস্যু থাকত আবার অনেকে রাগারাগি করে যেয়ে পালিয়ে থাকত। তারা বলত ঐ জঙ্গলে দেবো-হাটা। আর কালে আবর্তে সেখান থেকে নাম হয়েছে দেবহাটা। তবে এই দেবহাটাকে ঘিরে একদিকে যেমন রয়েছে নানারকম কল্পকাহিনী ঠিক তেমনি রয়েছে অনেক প্রাচীন র্কীতি বা নিদর্শন।

প্রাপ্ত তথ্য মতে জানা গেছে, ১৮৬৭ সালে তৎকালীন বৃটিশ আমলে দেবহাটার টাউন শ্রীপুরে পৌরসভা গড়ে উঠেছিল। যার নাম ছিল “দেবহাটা পৌরসভা”। ঐ সময় বর্তমান বিভাগীয় শহর খুলনাতেও পৌরসভা গড়ে ওঠেনি। মূলত এটি এলাকার উন্নয়নের কাজে ও বিচারালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

সেই পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন দেবহাটা সদরের বাসিন্দা স্বনামধন্য ও প্রজাহিতৈষী জমিদার ফনীভূষন মন্ডল। যিনি একটানা ত্রিশ বছর পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মানুষের কল্যানার্থে ও সেবার মনোভাব নিয়ে অনেক স্থাপনা তৈরী করে গেছেন। তার মধ্যে আছে দেবহাটা পাইলট হাইস্কুল (বর্তমানে মডেল হাইস্কুল), থানার পাশে ফনীভূষনের মা ভূবন মোহিনীর নামে প্রতিষ্ঠিত চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি (যেটি বর্তমানে পুলিশ ফাঁড়ির আবাসন হিসেবে ব্যবহৃত হয়) সহ অসংখ্যা কল্যানকর স্থাপনা।

টাউন শ্রীপুরে ছিল ১৩ জন জমিদার ও গাঁতিদারের বসবাস। এর মধ্যে বড় জমিদার ছিল ৭জন। সবচেয়ে বড় জমিদার ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ রায় সরকার। সর্বশেষ জমিদার ছিলেন বলহরি সরদার, অরবিন্দু সরদার ও বৈদ্য নাথ সরদার। এসব কেবলই স্মৃতি -হারানো গৌরব।

দেবহাটা ও টাউনশ্রীপুরে এখন আর জমিদারদের বসবাস না থাকলেও রয়েছে তাদের বিশাল অট্টালিকা, ধর্মীয় উপসনালয়, থিয়েটার রুমসহ কিছু কারুকার্য। তবে সেখানে আর বাজেনা কোন বাজনা বা হয়না কোন নৃত্য। ব্রিটিশ শাসনামলেই নির্মিত সেই আকা-বাঁকা রাস্তাগুলো এখন হয়েছে পিচ ঢালা রাস্তা, যেটা যেয়ে মিশেছে জেলা শহরের সাথে।

সকল নিদর্শন সংরক্ষণের অভাবে আর অবহেলায় আজ ধ্বংশের মুখে। ব্যক্তিগত বা সরকারি উদ্যোগ নেই একেবারেই অথচ এই ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণ করতে পারলে এই জায়গাগুলো হয়ে উঠতে পারতো দর্শনার্থীদের পীঠস্থান, হতে পারতো তীর্থস্থানও। তাই দেবহাটার ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সরকারী ও বেসরকারী সমন্বিত কিছু উদ্যোগ।

পাকিস্তান সরকার আসার পরে সম্ভবত ১৯৫০-৫১ সালে টাউনশ্রীপুর পৌরসভাকে বিলুপ্ত করে। পাকিস্তান সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তৎকালীর রাওয়ালপিন্ডি হাইকোর্টে জমিদার অনীল স্বর্নকার মামলা করেছিলেন। কিন্তু দুভার্গ্যক্রমে আর পৌরসভা গড়ে ওঠেনি।

এভাবেই ইতি ঘটে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম পুরাতন নগরের স্বপ্ন- যেটা ফিরে আসেনি আজও। টাউন শ্রীপুর পৌরসভার সেই আমলে স্থাপিত প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর অন্যতম নিদর্শন কারুকার্য খচিত প্রবেশ ফটক আর নাম ফলকটিও সংরক্ষণের অভাবে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে মাত্র ক’দিন আগেই। দেশ ভাগের পর থেকে এই স্থাপনাটি ব্যবহৃত হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে। অতঃপর বর্তমানে এটি পোস্ট অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, প্রথমে গ্রামটির নাম ছিল শ্রীপুর। পৌরসভা, অবকাঠামো (রাস্ত), রাস্তার বাতি, সুপেয় পানি, জুনিয়র স্কুল থাকার কারণে পরবর্তীতে এর নাম দেওয়া হয় টাউন শ্রীপুর। ব্রিটিশ শাসনামলে এখানে মেটাল রোডও (সুরকি দিয়ে ঢালাইকৃত) ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে টাউন শ্রীপুর গ্রামে পৌরসভার পক্ষ থেকে গ্যাস পোস্টের মাধ্যমে রাস্তায় বাতি জ্বালানো হতো। এই রাস্তায় জমিদারদের চলাচল ছিল এজন্য সন্ধ্যার পর পেয়াদারা বাতিগুলো জ্বালাতো।

ব্রিটিশ শাসনামলে কনক কান্তি সরকার পৌরসভার পক্ষ থেকে সুপেয় পানির জন্য একটি পুকুর খনন করেন। পৌরসভার মানুষ খাবার পনি হিসেবে এই পুকুরের পানি ব্যবহার করতো। টাউন শ্রীপুর পৌরসভার মানুষ পুকুরটিকে পানির রিজার্ভ ট্যাংক হিসেবে অভিহিত করতো। অর্থাৎ সেই আমলেই একটি অত্যাধুনিক শহরের সকল সুযোগ-সুবিধাই ছিল আজকের বিলীন হয়ে যাওয়া আমাদের এই শ্রীপুরে।

পৌরসভায় আরও রয়েছে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত তারকাখচিত একমাত্র পুরাতন ভবন। এটি ব্রিটিশ শাসনামলে বিচারালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভবনের নকশা ও পলেস্তার খসে খসে পড়ছে। সংরক্ষণের অভাবে দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে এর অবয়ব। এর অস্তিত্ব প্রায় বিলীনের পথে।

ভাবা যায়! আজকের এই ছোট্ট জেলা সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার একটি ইউনিয়ন “টাউন শ্রীপুর” ছিল সেকালের তথা অবিভক্ত বাংলার অন্যতম অত্যাধুনিক নগরী। আমরা সকলে মিলে চেষ্টা করলে হয়তবা আমাদের হারানো দিনের এই গৌরবগুলো রক্ষা করতে পারতাম। তবে হারানো অতীত নিয়ে আমরা ভাবি না, ভাবি কেবল লাভজনক বর্তমান নিয়েই। তাই হয়তবা আমরাও ভবিষ্যতে হারিয়ে যাব অতীতের মতই। এখনো সবাই মিলে চাইলে রক্ষা করতে পারবো অতীতের গৌরবকে- যেটুকু বেঁচে আছে সেটুকুই।

আমরা আমাদের গৌরবময় অতীতকে বাঁচিয়ে রাখলেই কেবল আমাদের বর্তমানকে বাঁচিয়ে রাখবে ভবিষ্যৎ। বেঁচে থাকুক আমাদের আলোকোজ্জ্বল ঐতিহ্য সম্মৃদ্ধ মধুর অতীত আমদের মাঝে, আমাদের হয়ে। অতীতের আলোয় উদ্ভসিত হোক সকল অন্ধকার। নতুন দিনের সেই আলোর প্রত্যাশায়………..

লেখকঃ চিকিৎসক, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *