আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে (মঙ্গলবার) ফার্সি নতুন বছর শুরু হয়েছে। নতুন ফার্সি বছর ১৪০২ উপলক্ষে জনগণের উদ্দেশে দেয়া এক বার্তায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী নতুন বছরকে ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির বছর’ বলে নামকরণ করেছেন।
তিনি মঙ্গলবার ভোররাতে রেডিও-টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বাণীতে ইরানি জনগণসহ যেসব দেশে ফার্সি বছর চালু রয়েছে সেসব দেশের জনগণকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, বিগত ফার্সি বছরে অর্থনীতি ও জীবিকা ছিল ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সর্বোচ্চ নেতা বলেন, আগামী এক বছরও যেহেতু অর্থনীতিই দেশের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকবে তাই এ বছরের নামকরণ করা হলো ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির বছর’।
ইরানে সাধারণত প্রতি বছর ২১ মার্চ ফার্সি বছর শুরু হয় এবং এরপর তিন মাস অর্থাৎ ২১ জুন পর্যন্ত বসন্তকাল থাকে। সর্বোচ্চ নেতা তার ভাষণে ওই বসন্তের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, এ বছর প্রাকৃতিক বসন্তের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধ্যাত্মিক বসন্ত। বসন্তকালের শুরুতেই শুরু হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। রমজানের আধ্যাত্মিক মনোরম সমীরণে সিক্ত হওয়ার যে অবারিত সুযোগ আমাদের সামনে হাজির হয়েছে তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে হবে।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বিগত ১৪০১ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যতগুলো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে তার প্রতিটির মতো বিগত বছরও ছিল আনন্দ ও দুঃখের ঘটনার সংমিশ্রণ। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। অর্থনীতির ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ছিল সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সবার কষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষেরা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন বলে সর্বোচ্চ নেতা মন্তব্য করেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিছু ভালো ও গঠনমূলক কাজও হয়েছে যার ফল জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া কয়েক হাজার কারখানা আবার চালু, বিজ্ঞানভিত্তিক কোম্পানিগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বেকারত্বের হার কয়েক শতাংশ কমানোকে তিনি বিগত ফার্সি বছরে সরকারের গৃহিত উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেন।
সর্বোচ্চ নেতা বলেন, দেশের সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন সক্ষমতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বিগত বছরে যে মেলার আয়োজন করেছিল তা ছিল অর্থনীতির ক্ষেত্রে অন্যতম আশাব্যাঞ্জক দিক।
ইরানি উদ্যোক্তাদের গৃহীত পদক্ষেগুলো সম্পর্কে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে ইতিবাচক বলে ঘোষণা করেন সর্বোচ্চ নেতা। তিনি বলেন, যেসব ইতিবাচক কাজ হয়েছে সেসবের সুফল জনগণের ঘরে ঘরে বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের খাবারের পাতে পৌঁছে দিতে হবে। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্টি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ছাড়া এ কাজ সম্ভব নয়।
হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ফার্সি নববর্ষ উপলক্ষে দেয়া ভাষণে আরো বলেন, অবশ্য অর্থনৈতিক সমস্যা যে শুধু ইরানের একার ছিল তা নয়; বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ বিগত এক বছরে কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ছিল। এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলিও বাদ যায়নি। বিশ্বের কথিত সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশেও একের পর এক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।
সর্বোচ্চ নেতা বলেন, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের চলতি বছরে এতটা উদ্যোগী ও উদ্যমী হতে হবে যাতে আগামী বছরে আর কোনো দুঃখজনক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে না নয়। তিনি বলেন, ১৪০২ সালেও সরকারের মূল কাজ হবে দেশের অর্থনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, অর্থনীতি নিয়ে এতসব কথার অর্থ এই নয় যে, দেশের অন্য খাতগুলোতে সমস্যা নেই বরং রাজনীতি ও সংস্কৃতিসহ অন্যান্য খাতেও নানা সমস্যা ও সংকট বিদ্যামান। কিন্তু যদি সরকার, পার্লামেন্ট ও দেশের তরুণ সমাজ এসব সমস্যার সমাধান করার জন্য এগিয়ে আসে এবং নিরলস প্রচেষ্টা চালায় তাহলে দেশের বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
উৎপাদনের পাশাপাশি পুঁজি বিনিয়োগের ওপর জোর দিয়ে সর্বোচ্চ নেতা বলেন, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দেশের ছোট-বড় খাতগুলোতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হবে।
ফার্সি ১৩৯০-এর দশকে পুঁজি বিনিয়োগের দিক দিয়ে ইরানের পিছিয়ে পড়ার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে একটি বড় বাধা হচ্ছে পুঁজি বিনিয়োগের কিছু কিছু ক্ষেত্রে শূন্যতা সৃষ্টি এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, আমি দেশের সকল সমস্যা পর্যালোচনা করে মূল্যস্ফীতিকে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছি এবং উৎপাদনকে দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছি। এ কারণে আমি ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি’কে ১৪০২ সালের স্লোগান হিসেবে নির্ধারণ করলাম।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, এই স্লোগান বাস্তবায়নের কাজে দেশের অর্থনৈতিক তৎপরতায় অংশগ্রহণকারী সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিষয়টি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজে আইআরআইবি’কে [ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা] গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। আর তা করতে পারলেই প্রথমত, মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে এবং দ্বিতীয়ত উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা তাঁর নববর্ষের বাণীর শেষাংশে হযরত ইমাম মাহদি (আ.)-এর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। সেইসঙ্গে ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) এবং শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। পাশাপাশি নতুন বছরে ইরানি জনগণের উত্তরোত্তর সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী।