ডেস্ক রিপোর্ট : সারাদেশে বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে টানা পাঁচ মাস ধরে। পদোন্নতির জন্য মূল্যায়নের বিধান রেখে এমপিও নীতিমালা জারি করলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পদোন্নতিযোগ্য শিক্ষকদের মূল্যায়নের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় আটকে আছে পদোন্নতি। এ অবস্থায় সারাদেশের ৯ শতাধিক শিক্ষক পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করেও প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন। সব যোগ্যতা অর্জন করলেও পদোন্নতি না নিয়েই গত পাঁচ মাসে অবসরে চলে গেছেন অন্তত দেড় শতাধিক শিক্ষক।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৮ মার্চ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ জারি করা হয়। এতে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে ৫ : ২ অনুপাত প্রথা তুলে দেওয়া হয়। পরিবর্তে মোট প্রভাষকের অর্ধেক (৫০ : ৫০) পদোন্নতি পাবেন বলে বিধান রাখা হয়। তবে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, পদোন্নতির জন্য কলেজ পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠন করা একটি মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে শিক্ষকদের পদোন্নতির যোগ্যতা মূল্যায়ন করা হবে। ১০০ নম্বরের একটি মূল্যায়নের মুখোমুখি হতে হবে শিক্ষকদের।

এ জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে একটি মূল্যায়ন কমিটিও গঠন করা হয়। তবে এ কমিটির সভাপতি মো. মমিনুর রশীদ আমিন সরকারের সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে বদলি হয়ে গেলে মূল্যায়ন কার্যক্রম থেমে যায়। কমিটির অন্য সদস্যরাও এ বিষয়ে কোনো কিছু বলতে পারেননি। মূল্যায়ন কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) ডা. সৈয়দ ইমামুল হোসেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক ও মাউশির ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক মো. মনোয়ার হোসেন। এ কমিটির সদস্য সচিব মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব কামরুল হাসান।

শিক্ষকরা জানান, আগের এমপিও নীতিমালায় বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য প্রচলিত অনুপাত প্রথা চালু ছিল, যা ৫ : ২ হিসেবে পরিচিত। এর অর্থ হলো, কোনো কলেজে এমপিওভুক্ত সাতজন প্রভাষক থাকলে তাদের মধ্যে মাত্র দু’জন সহকারী অধ্যাপক হতে পারবেন। বাকিরা আজীবন প্রভাষক হিসেবে থাকবেন। এই অনুপাত অনুসারে, কোনো কলেজে মোট প্রভাষকের সংখ্যা ১৪ জন হলে তাদের মাত্র চারজন সহকারী অধ্যাপক হতেন। চরম বৈষম্যমূলক এই নীতিমালা বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের ‘গলার কাঁটা’য় পরিণত হয়েছিল। ১৯৮০ সাল থেকে এই অনুপাত প্রথা চালু হয়। বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের দাবির মুখে চলতি বছর এই অনুপাত প্রথা বাতিল হয় এবং পদোন্নতির অনুপাত ৫০:৫০ নির্ধারণ করা হয়।

মাউশি থেকে জানা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে এমপিওভুক্ত ডিগ্রি কলেজ আছে এক হাজার ৩৬টি। স্কুল অ্যান্ড কলেজ আছে এক হাজার ৪৯১টি এবং উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ আছে ১০২৮টি। নন-এমপিওভুক্ত কলেজ আছে প্রায় দুই হাজারের মতো। এসব কলেজে প্রায় দেড় লাখ কলেজ শিক্ষক রয়েছেন। মাদ্রাসায় কর্মরত প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকদের হিসাব সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। পদোন্নতি পেতে প্রভাষকদের আট বছর চাকরিকাল পার হতে হয়। যারা সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন না, তারা চাকরির ১০ বছর পূর্তিতে উচ্চতর স্কেল প্রাপ্য হন। এতে তারা জাতীয় বেতন স্কেলের নবম গ্রেড থেকে অষ্টম গ্রেডে উন্নীত হন। এ ছাড়া পদোন্নতিবঞ্চিতদের চাকরির ১৬ বছর পূর্তিতে আরেকটি গ্রেড স্কেলে উন্নীত হওয়ার বিধান রয়েছে।

শিক্ষকদের কথা: এ বিষয়ে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া কলেজের ভূগোল বিষয়ের প্রভাষক মো. শুকবর আলী সমকালকে বলেন, গত ১১ আগস্ট ছিল আমার অবসর নেওয়ার তারিখ। চাকরিজীবনের শেষ পর্যায়ে এসে পদোন্নতি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। তাই ২৮ মার্চ নতুন নীতিমালা জারির পর প্রভাষক পদে ৩১ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা নিয়ে মে মাসে সহকারী অধ্যাপক পদে আবেদন করি। কিন্তু নীতিমালার অস্পষ্টতার বিষয় জানিয়ে সেটা বাতিল করা হয়। অথচ যদি ৫ : ২ প্রথাতেও পদোন্নতি দেওয়া হতো, সেটা আমারই পাওয়ার কথা। কিন্তু নতুন নীতিমালার কারণে আমাকে প্রভাষক হিসেবেই অবসরে যেতে হলো। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মহিষকুণ্ডি কলেজের মনোবিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক রেবেকা সুলতানা বলেন, ১৮ বছর হয় প্রভাষক পদে কর্মরত আছি। নতুন নীতিমালায়  পদোন্নতির আশা করছি। জানি না কবে হবে সেই মূল্যায়ন কমিটি।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর দুর্গাদাস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের হিসাববিজ্ঞানের প্রভাষক মো. আব্দুস সালাম বলেন, সব হলো, মূল্যায়ন কমিটির নামে আবার ঝুলিয়ে রাখা হলো। আসলে বেসরকারি শিক্ষকদের হয়রানি আর অবমূল্যায়ন করতে একটি মহল বরাবরই সিদ্ধহস্ত। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার খলিশাডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজের ফিন্যান্সের প্রভাষক মো. আতিকুর রহমান মৃধা বলেন, নীতিমালায় থাকা আইনের ধারাগুলো শিক্ষক-কর্মচারীদের ওপর সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োগ শুরু হয়। কিন্তু প্রদেয় সুবিধাগুলো বাস্তবায়নে গড়িমসি করে বছরের পর বছর পার করা হয়। তিনি বলেন, ২০২১-এর সংশোধিত নীতিমালায় ১১.৪ এবং ১১.৫ ধারায় শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ বেড়েছে। কিন্তু সেখানেও পথ আটকে রাখা হয়েছে। ১১.৬ ধারায় বলা হয়েছে, একটি কমিটি করা হবে। সেই কমিটি ১০০ নম্বরের মূল্যায়ন করে তবেই তারা পদোন্নতি দেবেন। সেই কমিটি গঠনের রূপরেখা তৈরি করতে আরও কতদিন লাগবে- এই প্রশ্নের উত্তর কোথায় মিলবে, কে জানে!

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য: মূল্যায়ন কমিটির বর্তমান প্রধান অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) ডা. সৈয়দ ইমামুল হোসেন  বলেন, কভিড-১২ পরিস্থিতির কারণে প্রত্যক্ষভাবে কোনো সভা করা যাচ্ছে না। তবে শিক্ষকদের কীভাবে পদোন্নতি দেওয়া যায়, তা বিবেচনা করা হচ্ছে। আশা করছি শিগগির কিছু একটা করা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *