::নাজমুল হক::
সমাজে অক্টোপাসের মতো চেপে ধরেছে মাদক। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত সকল স্তরে পৌঁছে গেছে মাদকের ভয়াবহতা। শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। তার বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যের শক্তি ও সম্ভাবনা। সর্বনাশা মাদক ধ্বংস করে একটি মানুষের শরীর, মন, জ্ঞানবিবেক ও তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তার পরিবারের সব স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ। শুধু পরিবারকে নয়, মাদকের কালো থাবা ধ্বংস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের অবক্ষয়, হতাশা এবং মূল্যবোধের অভাবের সুযোগ নিয়ে মাদক তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তরুণসমাজের প্রতি।
মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচটি সংস্থার (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, (বিজিবি), র্যাব ও কোস্টগার্ড) ১২ বছরের (২০০৯-২০২০) উদ্ধারকৃত মাদকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে একটি জাতীয় প্রত্রিকা। ১২ বছরে কেবল নয়টি মাদক যে পরিমাণে উদ্ধার হয়েছে, প্রচলিত দাম অনুযায়ী টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ দাঁড়ায় আনুমানিক ১৪ হাজার ৩১৩ কোটি ৭৯ লাখ ৬২ হাজার ১৩০ টাকা। পাঁচ সংস্থার মাদক উদ্ধারের ঘটনায় এক যুগে ৭ লাখ ৯৩ হাজার ৩৮২টি মামলা হয়।
সর্বোচ্চ মামলা হয় ২০১৯ সালে ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৮টি এবং সর্বনিম্ন হয় ২০০৯ সালে ২৭ হাজার ৪৪১টি। মোট মামলায় আসামি করা হয় ১০ লাখ ১০ হাজার ৭১৮ জনকে। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৬২ হাজার ৮৪৭ জন আসামি হন এবং ২০০৯ সালে সর্বনিম্ন ৩৪ হাজার ৩১৫ জন আসামি হন। তাই মাদক রুখতে আইনের প্রয়োগ করতে হবে আরও কঠোরভাবে।
মাদকাসক্তি নিরাময়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা, পরিমিত জীবন-যাপন, বন্ধু নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে পরিবার সচেতন হলে সন্তানকে এই ভয়াবহ আসক্তি থেকে দূরে রাখা সম্ভব। তাই সন্তান কোনো অস্বাভাবিক জীবন-যাপন করছে কী না, কেমন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিশছে ইত্যাদি বিষয়ে পরিবারের নজর রাখতে হবে। তাছাড়া পরিবারের কেউ মাদকাসক্তির দিকে ঝুঁকে গেলে তাকে মাদকের খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে বোঝাতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত রাখাও মাদক থেকে তাদের দূরে রাখার একটি উপায় হতে পারে।
সমাজ থেকে মাদক একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। মাদকের সাথে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ জড়িয়ে আছে। আবার সরকারও মাদকের লাইসেন্স দিয়েছে। তাই মাদক থেকে দূরে থাকতে হলে নিজেকে সচেতন হতে হবে। শখ বা কৌতুহল বশতও মাদক গ্রহণ করা যাবে না।
দুটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে মানুষ মাদক থেকে আপনা-আপনি দূরে থাকবে। প্রথমত, মাদক থেকে যুব সমাজকে দূরে রাখতে হলে সরকারি-বেসরকারি চাকুরিতে প্রবেশের পূর্বেই ডোপ টেস্ট করাতে হবে। টেস্টে রিপোর্ট পজেটিভ আসলেই তিনি চাকুরিতে যোগদান করতে পারবেন না। আবার চাকুরিরতদের প্রতি ৩ বছর পর পর কর্মরত প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই ডোপ টেস্ট করাতে হবে। পজেটিভ হলেই চাকুরিচ্যুত করতে হবে। এজন্য ডোপ টেস্ট বিধিমালা পাশ করার পাশাপাশি সকল দপ্তরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠি করলেই হবে। প্রয়োজনে সরকার টেস্টের খরচ যোগাবে।
দ্বিতীয়ত, হলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেন নির্বাচন কমিশন। এক্ষেত্রে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন বড়ই প্রয়োজন। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল কমিটি থেকে মাদকাসক্তদের বাদ দিতে হবে। নতুন কমিটি গঠনের সময় সেই বিষয়টি বিবেচনায় আরো বেশি করতে আনতে হবে। প্রত্যেক দলের নেতারা মাদক, দুর্নীতি নির্মূলে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন জনসভায়। কিন্তু সরিষার মধ্যে যদি ভুত থাকে তা তাড়ানো যায়কি? তাই সরিষার ভুতকে তাড়াতে হবে সবার প্রথমে। গাছের গোড়া আলগা রেখে দিয়ে যেমন গাছ বাঁচে না তেমনি মাদকের জন্য বর্ডার খোলা রেখে দেশের ভিতর মাদক নির্মূল সম্ভব নয়। প্রয়োজনে সীমান্তে বিজিবি, কোস্টগার্ড বাড়িয়ে নজরদারি করতে হবে। মাদক নির্মূল যাদের দায়িত্ব তারা বিপদগামী হলে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। প্রয়োজনে প্রতি বছরই তাদের পরিবারসহ সম্পদের হিসাব নিতে হবে। লেখক: আহবায়ক, স্বপ্নসিঁড়ি, সাতক্ষীরা