মানুষ মানুষের জন্য; জীবন জীবনের জন্য। প্রাচীনকালে মানুষ একাকী ও গুহায় বসবাস করতো। তখন মানুষের পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহধর্মীয়তার অভাব ছিলো। একসময় মানুষ বাঁচার তাগিদে, জীবনের প্রয়োজনে দলবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করে। কালের বিবর্তনে তৈরি হয় সমাজ, গোষ্ঠি, গ্রাম এমনকি জন্ম হয় রাস্ট্রের। যার প্রতিটির উদ্দেশ্য হলো মানব কল্যান। মানুষকে উপকার করা, সেবা করা; অসহায়, নিপীড়িত মানুষকে বাঁচতে সকল ধরণের সহযোগিতা করা। আর এটিই হলো মানুষের প্রতি মানুষের ধর্ম।
ধর্ম, মানুষের সুখ-শান্তি ও পথ প্রদর্শন এবং আলোর সন্ধান দিবার জন্য। ধর্মের মৌলিক অংশ দু’টি। প্রথমটি হলো সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের কর্তব্য। সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত যে নিয়মেই হোক না কেন, তা মৌখিক ভাবে প্রকাশ, আন্তরিকতার সঙ্গে বিশ্বাস স্থাপন এবং কার্যত প্রকাশ করলে সাধারণত আল্লাহর হক আদায় হয়। দ্বিতীয়টি হলো মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্য। মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে ভালবাসে, জীবন ধারণের জন্য একে অপরের প্রতি নির্ভর করে। একে অপরের সহায়তা করবে এবং করে থাকে এটাই স্বাভাবিক। এটিই হলো মানবধর্ম।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে খেটে খাওয়া মানুষরা বড় বিপাকে পড়েছে। তাদের ঝুঁকিটা শুধু স্বাস্থ্যগত নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি জীবন ধারণের। যদিও স্বাস্থ্য হলো সবার উর্ধ্বে, কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য প্রয়োজন জীবিকা। নিম্ন আয়ের মানুষ, দিনমজুর, বিশেষ করে শহরের নিত্য আয়ের মানুষগুলো নিরন্তন পরিশ্রম করছে লক ডাউনে বিধি নিষেধ মেনে নিজের ও পরিবারের ক্ষুধা নিবারণে। জীবন নাকি জীবিকা সেই প্রশ্নই যখন বড় করে দেখা দিয়েছে তখনই সমাজের অগ্রদূত হয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের সহযোগিতার হাত বাঁড়িয়ে দিয়েছে একদল মানুষ। কোন প্রকার প্রত্যাশা না করেই খাদ্য সহায়তা প্রদান করছে নিপীড়িত মানুষের মধ্যে। এটিই হলো জীবনের জন্য পরম ধর্ম।
চাকরি সকল সেক্টরে করে কিন্তু চিকিৎসক-নার্সরা তাদের জীবন বাজি রেখে আমাদের জীবন রক্ষা করছে। আমরা যখন পরিবার-পরিজন নিয়ে সুন্দর সোফায় বসে টিভিতে নিউজ দেখছি, করোনা আক্রান্ত রোগী থেকে মানুষ যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, অবহেলা করছে, রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে ঠিক তখনই জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসকরা দিন-রাত নিরন্ত্রন পরিশ্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে ছন্দের বাংলাদেশ উপহার দিতে। তাইতো যুগে যুগে চিকিৎসা সেবা মানুষের পরম ধর্ম হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
ডাক্তার তার সেবা দ্বারা, বক্তা তার বক্তৃতার মাধ্যমে, লেখক তার লেখার মাধ্যমে, বিত্তশালীরা তার সম্পদ দ্বারা, বুদ্ধিমান তার বুদ্ধির দ্বারা, জ্ঞানী তার জ্ঞান দ্বারা, স্বাস্থ্যবান তার শক্তির দ্বারা সমাজের সেবা করতে পারে। আমরা সবাই যদি নিজ নিজ স্থানে অন্যকে আলোর দিকে পথ দেখাই, সুপথের দিকে আহ্বান করি তাহলে অনেক অশুভ থেকে আমরা মুক্ত থাকতে পারব। বিদ্যার দ্বারা জনসেবা করলে বিদ্যা কমে যায় না বরং তার বৃদ্ধি ঘটে, প্রদীপ্ত হয়ে উঠে। প্রয়োজন শুধু পরস্পর সহযোগিতার।
খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময় এখনই, রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় সেবামূলক কাজ করছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও শুকনো খাবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। যা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী হয়তো তা যথেষ্ট নয়। আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। আমার আশপাশের প্রতিবেশীর দিকে আমাকে দৃষ্টি দিতে হবে। আমার কোন প্রতিবেশী যেন না খেয়ে রাত্রি যাপন করে সে বিষয়টি আমার নিশ্চিত করতে হবে। সৃষ্টির প্রতি আমার যে কর্তব্য রয়েছে তা আমাকে অবশ্যই আদায় করতে হবে।
অপরের অশ্রু দর্শনে যার হৃদয় বিগলিত হয় না, সে জনসেবার দাবি করতে পারে বটে, কিন্তু কার্যত কোনো উপকারই করতে পারে না। দুখীর দুঃখমোচন, বিপন্নকে উদ্ধার, শোকাতুরের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা সৃষ্টি সেবার অন্তর্ভুক্ত। তাই আসুন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যার যার সামর্থ অনুযায়ী মানব সেবায় রত হই।
লেখক: আহবায়ক, স্বপ্নসিঁড়ি (সাতক্ষীরার প্রাক্তন রোভার স্কাউটদের সংগঠন, সাতক্ষীরা