ডা. সুব্রত ঘোষ : কালে কালে যুগে যুগে কিছু জাতীয় বীর জন্মায় যাদের জন্ম না হয়ে হয়তবা আমাদের ইতিহাসটাই অপূর্ণ থেকে যেত। স্বার্থপর এই সমাজে কেউ তাকে স্মরণ না করলেও ইতিহাস দম্ভভরে তাঁদের স্মরণ করে যাবে চিরকাল। প্রায় হারিয়ে যাওয়া একটি নাম মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টরের প্রতিষ্ঠাতা সাব-সেক্টর কমান্ডার কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার।
১৯৩৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী টাউন শ্রীপুরের বিখ্যাত মিস্ত্রি বংশে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তৎকালীন বৃটিশ শাসন আমলে সাত জমিদারের বসতি ও বাংলাদেশের প্রথম পৌরসভা টাউনশ্রীপুর গ্রামের মুন্সী খিজির মিস্ত্রির পুত্র। খেয়ালী বিধাতার ইশারায় হয়তবা ইতিহাস হবেন বলেই তের ভাই-বোনের মধ্যে একমাত্র তিনিই বেঁচে ছিলেন।
তার পিতা অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির সাদা মনের মানুষ ছিলেন। ধর্ম পরায়ন ব্যক্তি হিসাবে এলাকায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। হিন্দু জমিদার প্রতিষ্ঠিত টাউনশ্রীপুর প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। প্রাাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর টাউনশ্রীপুর শরৎচন্দ্র হাই স্কুলে ভর্তি হন।
তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় মাতৃভাষা রক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। তিনি তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভাষার প্রতি সম্মান জানিয়ে নিজ বিদ্যালয়ে ৪০জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করেন।
সেখানে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়ার পর তিনি সকলের নজর কাড়েন। ১৯৫৪ সালে তিনি উক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরে সাতক্ষীরা মহাকুমার একমাত্র কলেজে আইকম ক্লাসে শাহজাহান মাস্টার ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তিনি আই.কম পাশ করেন।
পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে কুষ্টিয়া ডিগ্রী কলেজ থেকে বি.কম পাশ করেন। একই বছরে সাতক্ষীরা পদ্মশাখরা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ১৯৫৯ সালে শ্যামনগর থানার ভেটখালী হাইস্কুলে একই পদে যোগদান করেন। সাথে সাথে ১৯৬২ সালে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড পাশ করেন এবং শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন।
পরবর্তীতে টাউনশ্রীপুর ও সখিপুর হাইস্কুলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পদ্মশাখরা স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বকালীন সময়ে হাড়োদ্দাহ নিবাসী মো. আজিজুর রহমানে’র কন্যা রাবেয়া খাতুন’কে বিবাহ করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানী মিলিটারী পরিচালিত মুজাহীদ বাহিনীতে যোগদান করেন।
তার দক্ষতার ফলে পাকিস্তান সরকার তাকে সাতক্ষীরা মহাকুমা মুজাহীদ বাহিনীর দায়িত্ব দেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার তাকে ক্যাপ্টেন উপাধীতে ভূষিত করেন। একারণেই তিনি “ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার” নামে পরিচিত হন। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে’র ডাকে সাড়া দিয়ে দেশ রক্ষার্থে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।
তিনি স্থানীয় যুবকদের নিয়ে নিজ এলাকায় মুক্তি বাহিনী গঠন করেন। দেবহাটা থানায় পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে “জয় বাংলা পতাকা” উত্তোলনের নির্দেশ দেন। বিওপির ৬ জন পাকিস্তানী ইপিআরদের বন্দী করে তাদের কাছ থেকে চায়না রাইফেল ছিনিয়ে নেন।
যুদ্ধকালীন সময়ে ৯নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প টাউনশ্রীপুর হাইস্কুলে স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার ভারতের টাকীতে মুক্তি বাহিনীর প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করেন। যেটি শেষ পর্যন্ত “নয় নম্বর সেক্টর” -এর মর্যাদা পায়। একারণে তাকে নয় নম্বর সেক্টরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
দীর্ঘ নয় মাসে যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলার নিজ এলাকায় ফিরে এসে পুনরায় শিক্ষাকতায় যোগদান করেন। ১৯৮৫ সালে তৎকালনি রাষ্ট্রপতি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশে প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তিনি দেবহাটা উপজেলার প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৯০ সালে তিনি নিজের শরীরের মূল্যবান অংশ দুইটি চক্ষু রেজিষ্ট্রীর মাধ্যমে আই ব্যাংকে দান করেন। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই সখিপুর হাইস্কুলে ক্লাস নেওয়ার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সাথে সাথে তাকে সখিপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
পরে দুপুর ১২.৩০ মিনিটে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন ২৪ জুলাই টাউনশ্রীপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গনে বিকাল ৫টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।
সদালাপী, নিভৃতচারী, শিক্ষানরিাগী আজীবন সমাজসেবী এই মানুষটি জীবনের শেষ মুহুর্তটি পর্যন্ত সমাজ সেবায় আত্ম নিয়োগ করে গেছেন। জাগতিক কোন লোভ-লালসা তাঁর জীবনের পথ চলাকে ব্যাহত করতে পারেনি। ক্ষমতার যে স্থানে ছিলেন সেই স্থানে থেকে প্রচুর ধন সম্পদের মালিক হতে পারতেন তিনি।
তবে সাদাসিদে সরলমনা এই মানুষটি কেবল দেশের কল্যাণে মন দিতে গিয়ে খেয়াল নিতে পারেন নি নিজের পরিবারেরও। তাঁর এ পথচলায় সাথে পেয়েছিলেন যোগ্য প্রিয়তমা স্ত্রী এবং নির্লোভ সন্তানদের। এই বীরের আধা পাঁকা বাড়িটিই জানান দেয় তিনি কতটাই সৎ ছিলেন।
নষ্ট হয়ে যাওয়া এই সমাজে শাহজাহান মাস্টারে’র মতো লোকরাই আমাদের আদর্শ হয়ে থাকবেন চিরকাল। জয় হোক ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার -এর আদর্শের, ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকুক চিরকাল। জয় বাংলা।