সেদিন বাংলার আকাশে-বাতাসে ছিল আনন্দের ঘনঘটা। পুরো দেশবাসী অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছিল তাদের প্রিয় নেতার জন্য। কখন আসবেন স্বাধীন বাংলার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন ভূমিতে পা রেখে ধন্য করবেন দেশকে।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে একে একে নয়টি মাস কারাজীবন থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। মহান এ নেতার প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ের পূর্ণতা আসে। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১০ জানুয়ারি একটি অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন হিসেবে চিহ্নিত। স্বয়ং জাতির পিতা তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’ বলে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লন্ডন-দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের সমস্ত মানুষের দৃষ্টি তখন ঢাকা বিমানবন্দরের দিকে। বিমানবন্দর থেকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত এলাকা ছিল লোকে লোকারণ্য। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে।
দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার পর অবশেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বিজয়ের বেশে বিমান থেকে নামলেন। পা রাখলেন এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলার মাটিতে। গোটা বাঙালি জাতি তেজদীপ্ত কণ্ঠে বলে উঠল ‘জয় বাংলা’।
প্রিয় বাংলাভূমিতে পা রেখেই কোটি মানুষের ভালবাসায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের অমানবিক নির্যাতন ও গণহত্যার সংবাদ শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার পর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের এ অভিযানের শুরুতেই পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমণ্ডির ৩২ নাম্বার বাসা থেকে বন্দি করে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে যান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর নামেই চলে মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে থাকাকালে তার জীবননাশের সম্ভাবনা ছিল। প্রহসনমূলক বিচারের রায় অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি নিশ্চিত করার জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো প্রলোভন ও ভয়-ভীতিই বঙ্গবন্ধুকে বাঙালির জনদাবি ও গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচলিত করতে পারেনি।
কারাগারে থাকাকালে জাতির পিতা মাথা উঁচু করে বলেছিলেন, ‘আমার লাশটা বাংলার মানুষের কাছে পাঠিয়ে দিও’। মহান এই নেতার দৃঢ়তার কারণে পাকিস্তানের নুতন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জুলফিকার আলী ভুট্টোর কনফেডারেশনের স্বপ্নও ধূলিসাৎ হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু ছিলেন আরো বেশি শক্তিশালী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি যুদ্ধে স্বশরীরে না থাকলেও ছিলেন সবখানে। পৃথিবীতে এমন ঘটনা বিরল যে, নেতা ১২শ’ মাইল দূরে কারাগারে অবস্থান করেও তার নামের ওপর ভিত্তি করে একটি দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ সার্বিক অবস্থা যখন বিপর্যস্ত, তখন স্বদেশে ফিরে এসে জাতির বুকে আবার আশার সঞ্চার করলেন এই মহান নেতা।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা দেন- ‘রক্ত দিয়ে হলেও আমি বাঙালি জাতির এই ভালবাসার ঋণ শোধ করে যাবো’। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি আমার বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়’।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অল্প সময়ের মধ্যেই মিত্রবাহিনীর সেনা প্রত্যাহার, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিকসহ সার্বিক পুনর্গঠন, শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, সংবিধান প্রণয়ন, জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভসহ বিভিন্ন কার্যক্রম দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে। যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়।