আজ মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারি। ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংগালীর গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন, মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আজকের এই দিনে সকল বীর শহিদদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা, যাদের আত্নত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি লাল সবুজের এই পতাকা, পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক দিনটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের সাহসী ঠিকানা। অমর ২১ শের পথ ধরেই বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক, বিশ্বের লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের মহান নেতা, বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য পুরুষ, বাঙালির নিরন্তন প্রেরণার চিরন্তন উৎস, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসম সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের জীবনের বিনিময়ে বাঙালির বিজয় অর্জিত হয়েছে।
বিশ্বের ইতিহাসে বাঙালিই একমাত্র জাতি যারা নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষায় জীবন দিয়েছে। ভাষার জন্য সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, বিপ্লব পৃথিবীর অন্য কোন এসে সংঘটিত হয়নি। ইতিহাসে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রত্যেক জাতিই জন্মগত ভাবে প্রাপ্ত ভাষায় স্বাধীনভাবে কথা বলে এবং মনের ভাব প্রকাশ করে। সেখানে বাংলা
ভাষার ওপর আঘাত, ফুঁসে ওঠে বাঙালি। রাজপথে আন্দোলন। প্রতিবাদ কবিতায়, প্রতিবাদ গানে। কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কিংবা ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’ অথবা ‘মাগো, ওরা বলে সবার কথা কেড়ে নেবে’- এসব সৃষ্টি অনিবার্যভাবে তুলে ধরেছে বাঙালির প্রতিবাদী রূপ। রক্ত দিয়ে কেনা মায়ের ভাষা, আর শহীদদের আত্মত্যাগ বাঙালি জীবন-দর্শন ও সাহিত্যের শক্তি।
পৃথিবীর বুকে ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে, অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার ইতিহাস সৃষ্টিকারী জাতি কেবলমাত্র বাঙালি। ২১ শে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির চেতনার প্রতীক। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহর রক্তে রাঙানো অমর ২১ শে বাঙালির পথের দিশা, প্রাণের স্পন্দন। কবির ভাষায়ঃ
লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিমেয়ে পেয়েছি যে বিজয় নিশান।
প্রয়োজনে আবার রক্ত দিবো ঢেলে,বজায় রাখতে বিজয়ের মান,
মোদের দেহে থাকতে রক্ত,
বৃথা যাবে না শহিদের দান ”।
ভৌগলিক স্বাধীনতা না থাকলেও ভাষার স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার কিন্তু বিশ্ববাসী বিষ্ময়বিভুতচিত্তে অবলোকন করেছে। জন্মগত অধিকার মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য বাংলার ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, পেশাজীবী, কৃষক, মজুর থেকে শুরু করে সর্বস্তরের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের গুলিতে জীবন দিয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ অসংখ্য তাজা প্রাণ। রক্তের বন্যায় সিক্ত হয়েছে বাংলা মায়ের বুক। তাই জাতি হিসেবে আমাদের ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসার জন্য ইউনেস্কো ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের দিনটিকে
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বরে। মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদার স্বীকৃতি এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষার মাধুর্যে তাই মনে বেজে উঠে:
“তোমার কথায় কথা বলি, পাখির গানের মত
তোমার দেখায় বিশ্ব দেখি, বর্ণ কত শত ”।
২১ – একটি স্বপ্ন ও আমার অহংকার:
২১ শুধুমাত্র একটি সংখ্যা নয়, দিনপঞ্জিকার একটি দিন নয়; অমর ২১শে আমাদের অস্তিত্বের সাথে গভীরভাবে মিশে আছে। ২১ মানেই হলো- পরাশক্তির কাছে মাথা নত না করা। ২১ একটি বিদ্রোহ, বিপ্লব ও সংগ্রামের নাম। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহসও ২১ শে ফেব্রুয়ারি। ২১ হল মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য রাজপথ কাপানো মিছিল, স্লোগান, আন্দোলনে মুখরিত একটি মুহূর্ত। ২১ শের পথ বেয়ে এসেছে ৫৪’ র সাধারণ নির্বাচনে পাক-শাসকদের ভরাডুবি, ৬৬ র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে বাঙালির বিপুল বিজয়, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং অবশেষে পৃথিবীজুড়ে
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন। ২১ শে মানে তাই মাথা নত না করা, ২১ শে মানে মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে জীবনের গান গেয়ে যাওয়া, ২১ শে মানে বাঙালির অহংকার।
ফিরে দেখা ভাষা আন্দোলন: ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা ও সমুন্নত রাখা। ফলে ভাষা আন্দোলন আমাদের সংস্কৃতিকে যেমন পরিপুষ্ট করেছে তেমনি ভাষা ও সাহিত্যকে করেছে সুসমৃদ্ধ। ভাষা আন্দোলনে বাঙ্গালী ছাত্র ও তরুণ সমাজের রক্তদান এবং আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া শহিদ মিনার এখন আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, জাতীয় জাগরণের অনন্য প্রতীক। এখনো বাঙালী বিশ্বাস করেঃ
‘ জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার
তবু্ও মাথা নোয়াবার নয় ’।
ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। অতঃপর ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দেন: ‘Urdu only, and Urdu shall be the state language of Pakistan.’ এর তিনদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি একই কথা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করলে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। কিন্তু শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও জিন্নাহ এতে কোনো কর্ণপাত করেন নি।
১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একই ঘোষণা দিলে ছাত্রসমাজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
এর প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ সমগ্র পূর্ব বাংলায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের কর্মসূচি প্রদান করলে ছাত্র-জনতার মাঝে অভূতপূর্ব সাড়া জাগে। ২০ ফ্রেব্রুয়ারি মধ্যরাত থেকে সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু পূর্বসিদ্ধান্ত মোতাবেক একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারার বিধি-নিষেধ ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিলে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা অংশ নেয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তা উত্তাল জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করে।
মিছিলের ভয়াল রূপ দর্শন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার নির্দেশ দেন। পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, সফিউরসহ নাম না জানা আরো অনেকে। এতে সারা বাংলায় প্রতিবাদের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। সমগ্র জাতি সম্মিলিতভাবে গর্জে ওঠে সিংহের মত। পরিশেষে, শাসকগোষ্ঠী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেয়।
২১ শের পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালির মাঝে নবচেতনার জন্ম হয়, তা হচ্ছে স্বাধীকারের স্বপ্ন। এর পথ ধরেই আসে বাঙালীর মুক্তি ও স্বাধীন বাংলাদেশ। জন্ম নেয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
১৯৫২ র ২১ শের চেতনাকে ধারণ করেই তো ১৯৫৪ র নির্বাচনে খাজা নাজিমুদ্দিন সরকারকে হটিয়ে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ। এই সময় থেকেই আওয়াজ উঠল ‘এক ইউনিট বাতিল কর, স্বায়ত্তশাসন দাও’। সেই পরম্পরায় আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যাত হলো এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবি মুখ্য হয়ে উঠল। পরবর্তীকালে ১৯৬৬ তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা ও ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে ধীরে ধীরে নিয়ে চলল স্বাধিকারের দিকে। এরপরের ঘটনা তো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
মূলতঃ ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই বাঙালি জাতির চরম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। এর পথ ধরেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম নেয় লাল-সবুজের বাংলাদেশ। ভাষার জন্য জীবন দান, সে কী সহজ কথা? বাঙ্গালী জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখেছে তরুণ প্রাণেরা। মথানত করে নয় বরং মাথা উঁচু করে বীরের বেশে মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়ে রফিক, সালাম, বরকতরা এ দেশের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারন করে দিয়েছে। ৫২’র পর বিভিন্ন চড়াই-উতরাই বাইতে বাইতে ৭১ এ এসে মুক্তির স্বাদ পেলাম আমরা। রক্তে রঞ্জিত রাজপথ ধরেই পেয়েছি স্বাধীন বাংলা। ৫২-র সেই ভাষা আন্দোলন শুধু একটি ভাষা আন্দোলন ছিল না, ছিল একটি অহংকারের নাম। অমর ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাঙ্গালী জাতিকে মাথা উঁচু করে রাখার শক্তি সাহস আর প্রেরণা যুগিয়েছে ভবিষ্যতে ও যুগিয়ে যাবে।
তাই আমি দৃঢ়কণ্ঠে বলতে চাই ২১ শে ফেব্রুয়ারি হচ্ছেঃ
* ২১ আমার অহংকার
* ২১ আমার বুলি
* ২১ আমার ভাষার দাবি ফিরে পাওয়া
* ২১ আমার বাংলায় কথা বলা
* ২১ আমার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক
* ২১ আমার প্রেরণা
* ২১ আমার মাথা নত না করার শিক্ষা
* ২১ আমার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিবাদ
* ২১ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস
* ২১ আমার দেশের স্বাধিকার সংগ্রামের মূল ভিত্তি
* ২১ বাঙালি জাতির গৌরবান্বিত ইতিহাস ও অজেয় অহংকার
* ২১ আমাদের অহংকার,
আমাদের প্রেরণার অজস্র উৎস
* ২১ আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে একাধারে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবগাঁথা এক প্রাণভোমরা
* ২১ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ একুশের চেতনারই ফসল
* ২১ বাঙালির প্রতিবাদী এক রূপ
* ২১ রক্ত দিয়ে কেনা মায়ের ভাষা, আর শহীদদের আত্মত্যাগ বাঙালি জীবন-দর্শন ও সাহিত্যের শক্তি
২১ বাঙালির নিজের রক্তে অক্ষর কেনার দিন
* ২১ বাঙালিকে শিখিয়েছে যে কোনও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে। আমরা যখনই অন্ধকার শক্তির আক্রমণের শিকার হয়েছি, একুশে হয়ে উঠেছে তখন প্রতিরোধের সাহস
* ২১ আত্মত্যাগের অহংকারে ভাস্বর মহান একটি দিন, জেগে ওঠার প্রেরণা
* ২১ ফেব্রুয়ারী ও বাঙালির আত্ন অধিকারের লড়াই, বাঙালির চেতনার প্রতীক
* ২১ বাঙ্গালীর অসম্প্রদায়িক চেতনার বাতিগর
* ২১ দেশমাতৃকার প্রয়োজনে আত্মোৎসর্গ করার শপথ গ্রহণের দিন
* ২১ এর মধ্য দিয়েই পাকিস্তান-পরবর্তী যুগে প্রথম বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল
* ২১ এর মধ্যে আমরা বাঙালি সত্তাকে খুঁজে পাই
* ২১ আমাদের শক্তি ও সাহস জোগায়, দেশপ্রেম ও ভাষা চেতনাকে শাণিত করে
* ২১ আমাদের অহংকার, গৌরব, জাতিসত্তা ও প্রেরণার জায়গা
* ২১ গৌরব, প্রেরণা আর অহংকারের অমর এক দিন
* ২১ বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের সংগ্রামের সূচনার দিন
* ২১ ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির কাছে অন্তহীন প্রেরণার প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে
* ২১ স্বাধীনতা সংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে, এখনো দেখায়
* ২১ আমাদের জাতীয় মুক্তির চেতনার উৎস
* ২১ আমাদের আজ স্বদেশের আঙিনা পেরিয়ে বৈশ্বিক চেতনায় পরিণত হয়েছে
* ২১ বিশ্বজুড়ে মানুষের নিজ নিজ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার অঙ্গীকারের নাম
* ২১ ফেব্রুয়ারি মানে বিশ্বে মাতৃভাষার জন্য নির্ভয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার প্রথম ইতিহাস সৃষ্টির দিন
* ২১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করেই বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা ঘটে এবং শোষণ ও পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত হয় এদেশ ও জাতি
* ২১ বাঙালির ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় শোকের দিন।
* ২১ পৃথিবীর বুকে ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে, অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার ইতিহাস সৃষ্টিকারী জাতির এক অসম সাহসী শক্তি
* ২১ পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীয় কবল থেকে আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে এক অসম সাহসী শক্তি
* ২১ শে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির চেতনার প্রতীক। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহর রক্তে রাঙানো বাঙালির পথের দিশা ও প্রাণের স্পন্দন।
মূলতঃ বাংলার স্বাধীনতার বীজ ৫২ তেই রোপিত হয়েছিল, সেই বীজের ফল ৭১ এ বাঙালি পেয়েছিল। তাই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি:
” ওরা না থাকলে ভাষা হতো না বাংলা,
পেতামও না মোদের স্বাধীনতা ”
অমর ২১ শে আমাদের প্রেরণার উৎস। আমাদের সম্মিলিতভাবে দাঁড়াবার ভিত্তিভূমি রচিত হয়েছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারির দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমেই। বাংলাদেশের মানুষের গৌরবান্বিত ইতিহাস ও অজেয় অহংকার অমর ২১ শে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-একথা ভাবতেই বুকটা গর্ভে ভরে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী ও জাতিসত্তার মানুষ গত কয়েক বছর ধরে যথাযথ সম্মান ও গুরুত্ব সহকারে অমর ২১ শে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বাংলাভাষা ও বাংলাদেশকে স্মরণ করছে- এ এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। বাঙালির নিজের রক্তে অক্ষর কেনার দিন ২১ শে ফেব্রুয়ারি, আজ তার কোনও সীমান্ত নেই। এ এক এমন দিন, যার অস্তিত্ব পুরো বিশ্ব জুড়ে— সব মানুষের কাছে উজ্জ্বল, ভাস্বর।
আমরা জানি, মাতৃভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার মানুষ লাভ করে স্বয়ং স্রষ্টা থেকে। যে মাটির কোলে যে মানুষ জন্মগ্রহণ করে যে মাটির ভাষা তার অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে থাকে। তার চোখ, মুখ, বুকের সাথে লেগে থাকে সে ভাষার গভীর আবরণ। তার স্বপ্ন সাধনা, আশা-আকাঙ্খা, তৃপ্তি ও সম্ভাবনার সমস্ত আকাশ জুড়ে উড়তে থাকে মাতৃভাষার প্রাণময় নীল ঘড়ি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা শব্দটা উচ্চারণের সাথে সাথে যেন হৃদয়ের গভীর থেকে এক অভাবনীয় মুখের শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেহের কোষে কোষে। যেন সারা শরীর জুড়ে বয়ে যায় প্রশান্তির অমীয় বাতাস। আমার মাতৃভাষা আমার প্রাণের ভাষা। আমার হৃদয় মেলে বেরিয়ে আসা স্বপ্নের ভাষা-প্রাণের উচ্চারণ।
২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের অহংকার ও আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক। বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতির ইতিহাস যতদিন এই পৃথিবীতে সমুন্নত থাকবে ততদিন বাঙালি জাতি এই মহান ভাষা সৈনিকদের নম্রচিত্তে স্মরণ করবে:
‘‘ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি ’’।
জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ২১ শের তাৎপর্য অপরিসীম। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, সাহিত্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ চেতনাবাহী একটি স্মরণীয় দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। এদিন বাঙালি সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। ২১ আমাদের জাতীয় মুক্তির চেতনার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। আমাদের মহান ২১ আজ স্বদেশের আঙিনা পেরিয়ে বৈশ্বিক চেতনায় পরিণত হয়েছে। এখন আমাদের করণীয় হলো, জ্ঞানের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ বৃদ্ধিতে সাধ্যমতো প্রয়াস চালানো। মাতৃভাষার শক্তি বাড়িয়ে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে নতুন শতকের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করা, মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারকে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
বস্তুত, ২১ আমাদের গর্ব ও ২১ আমাদের প্রেরণার অজস্র উৎস। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে অমর একুশ একাধারে ইতিহাস ও ঐতিহ্য, গৌরবগাঁথা ও প্রাণভোমরা। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ২১ শের চেতনারই ফসল। তাই ২১ শের অবিনাশী চেতনা আজও আমাদের উজ্জীবিত করে। এই চেতনা অম্লান রেখে জাতির সব ধরনের কল্যাণ ও অগ্রগতির পথে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বিস্তার ঘটাতে হবে।
এগিয়ে যেতে হবে ২১ শের চেতনার পতাকা সমুন্নত রাখার জন্য। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই চেতনাকে সবার মধ্যে সঞ্জীবিত করার মধ্যেই নিহিত আছে এই মহান দিবসের সার্থকতা বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
পরিশেষে বলতে চাই, ২১ হোক জগতের সকল অনৈক্য, সংঘাত ও অশান্তির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ হাতিয়ার, হোক সমুদ্রপথের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অন্ধকার রাতের আশার প্রদীপ, সঠিক পথের দিক নির্দেশক “ পাঞ্জেরী”।
লেখক : আ.ন.ম তরিকুল ইসলাম
যুগ্ম সচিব ও পরিচালক, ক্রীড়া পরিদপ্তর।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।